বিনোদন প্রতিবেদক : এক দরিদ্র বাউল পরিবারে মমতাজ এর জন্ম। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে চরম অভাব আর দৈন্যতায়। বাবা মধু বয়াতির ছিল ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। ঘরহীন, সংসারহীন বাউল বাবার হাত ধরেই শিল্পী মমতাজের গানের ভুবনে পথ চলা। গানকে সঙ্গী করেই জীবনের সমস্ত ক্ষুধা নিবারণের এক জীবন্ত উদাহরণ কিংবদন্তি মমতাজ। কোনো বাধা-প্রতিবন্ধকতাই দমিয়ে রাখতে পারেনি গানপাগল মমতাজের স্বপ্নকে। গান দিয়েই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। হাজারো দুঃখের মাঝে গান গেয়েই আনন্দ খুঁজে পান। গানেই প্রেম-ভালোবাস, গানেই বিরহ অনুভূত করে চলছেন। ফলে সংসার জীবনের অস্থিরতা থাকলেও তা সঙ্গীত জীবনের কোনো ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। বরং নিজের সুর আর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতায় জনমানুষের আজ অতি কাছের মমতাজ। পালাগানে শুরু হলেও বিচ্ছেদ আর মুর্শিদী গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও মেলে ধরেছেন তার এই অসাধারণ প্রতিভা। আবার সঙ্গীত জীবনের বিশালতায় ঠাঁই দিয়েছেন রাজনীতি আর সামাজিক কর্মকাণ্ডকেও। ধলেশ্বরী পাড়ের সেই পালাগান শিল্পী মমতাজ আজ সংসদ সদস্যও। সঙ্গীত জীবন, রাজনীতি, সামাজিক ভাবনা, জীবনের অর্জন-বিসর্জন নিয়ে সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সায়েম সাবু

মমতাজ বেগম : ঢাকার শ্যামলীতে ১৯৭৬ সালে এক বাউল পরিবারে আমার জন্ম হয়। বাবা বিখ্যাত বাউল শিল্পী মধু বয়াতী। মা উজালা বেগম। বাবা মাকে নিয়ে তখন ঢাকায় থাকতেন। তবে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মণ্ডপ ইউনিয়নের ভাকুম নামক গ্রামই আমার আসল ঠিকানা। আমি আমার জন্ম পরিচয় বলতে গেলে এ গ্রামের নামই বলে থাকি। কারণ শিশুকালেই বাবা-মার সঙ্গে গ্রামে চলে যাই। ওই গ্রামের ধূলিবালিতেই আমার বেড়ে ওঠা।
মমতাজ : আমার বাবার দুই পরিবার ছিল। আমার বড় মায়ের ঘরে এক ভাই ও তিন বোন। আর আমার মায়ের ঘরে আমি এবং আরও দুই ভাই রয়েছেন।
মমতাজ : সেই জমিতে আপাতত আমার বাবা-মায়ের নামে ‘মধু-উজালা কোল্ডস্টোরেজ’ করেছি। তবে আরও পরিকল্পনা আছে।

মমতাজ : আমার চাচারা বেশ ভালোই ছিলেন এবং এখনও ভালোই আছেন। তারা আগে থেকেই বেশ ধনী। কারণ, তারা গানের ভক্ত থাকলেও ঘরোয়াভাবেই গান করতেন। বাউল বেশে গ্রামের বাইরে গিয়ে গান করতেন না। এ কারণে সংসারে কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন চাচাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার জীবনে গান ছাড়া আর কিছু ছিল না। বাবা এমনই গানপাগল ছিলেন যে, এক মাস দুই মাস বাড়িতে আসতেন না। দিনের পর দিন বিভিন্ন ফকিরি বাড়িতে, মাজারে বাউল গান করে বেড়াতেন। সংসারের প্রতি কোনো টান ছিল না। বড় পরিবার ছিল আমাদের। বাউল গান করে তো এত বড় সংসার চালানো সম্ভব হতো না। আমি দেখেছি, বাউলের গান শুনে মানুষ আনন্দ পায়, দুঃখের মাঝে সুখ পেতে চায় কিন্তু বাউলের কোনো মূল্যায়ন করে না। এখনও তাই। বাউলরাও হয়ত মানুষকে আনন্দ দিয়েই সুখ পায়। এ কারণেই সংসার জীবন বাউলদের নয়। মানুষের আনন্দ-বেদনার মাঝেই বাউলের জীবন।

মমতাজ : একপর্যায়ে বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে আমরা ক্রমেই বড় হচ্ছি, আর বাবা ঘরছাড়া হচ্ছেন। সংসারের কোনো চিন্তা করতেন না। দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি একের পর এক বিক্রি করতে থাকলেন। দীর্ঘদিন বাবা বাড়িতে না থাকায় মা অন্যের কাছে ধারদেনা করে সংসার চালাতেন। চাচারা সহযোগিতা করতেন। এরপর বাবা বাড়িতে এসে দেখতেন, অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। পরে ওই পাওনাদারের কাছে আরও কিছু টাকা নিয়ে জমি বিক্রি করতেন। এক সময় বাড়ির ভিটা এক চিলতে জায়গা ছাড়া কিছুই আর থাকল না। এরপর থেকেই অভাব ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। কারণ, তখন আর বিক্রির কিছুই ছিল না। তবে চাচাদের সংসার আগের মতোই ছিল।
মমতাজ : বাবা চাচাদের বাধা মানেননি। বাবা বলতেন, আমার এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে মমতাজ গান পছন্দ করে। ও গানও ভালো গায়। গাইতে থাকুন না, দেখি কী হয়। আমি ছিলাম বাবার সবচেয়ে ছোট সন্তান। বাবা আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করত। নদীতে গোসল করতে গেলে বাবা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতেন। আমাকে ছাড়া বাজারে যেতেন না। কোথাও গানের অনুষ্ঠান হলে বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন। আমিও বাবার গান অনেক পছন্দ করতাম। আমার বাবা চাচাদের বোঝাতেন। এক সময় চাচারাও বাবাকে বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকলেন।

মমতাজ : ওই সময় রজবের চাঁদে খাজা বাবার উপলক্ষে ঢাকা শহরে অনেক উরস হতো। মিরপুর এবং হাইকোর্ট মাঝারে বাউলদের দু’টি সমিতি ছিল। এই বাউল সমিতি থেকেই বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রামের ডাক আসত। আমি ছোটবেলায় দেখিছি, ঢাকা শহরে প্রচুর বাউল গানের অনুষ্ঠান হতো। প্রতি মোড়ে মোড়ে গান হতো। মিরপুর খাজা বাবা শাহ আলীর মাজারে মাসব্যাপী বাউল গানের অনুষ্ঠান হতে দেখেছি। বাবা মিরপুর বাউল ক্লাবে বসতেন। সেখান থেকেই নানা জায়গায় গান করতে যেতেন। এ কারণেই বাবা মাকে নিয়ে শ্যামলীতে থাকতেন। মূলত মিরপুর মাজার কাছে হওয়ার কারণেই শ্যামলীতে থাকা।
মমতাজ : না, শৈশব ঢাকায় কাটেনি। শিশুকাল ঢাকায় কেটেছে। আমার বয়স যখন চার বছর তখনই বাবা মাকে নিয়ে গ্রামে চলে যান। শৈশব গ্রামেই কেটেছে। গ্রামেই বাবার কাছে গান শুনতাম এবং শিখতাম।
মমতাজ : বেশিদিনের কথা তো নয়। এরপরেও বলতে হয়, তখন গ্রামের অবস্থা খুব ভালো ছিল তা বলা যাবে না। তিন দশক আগে গ্রামের যে চিত্র তা আমাদের ভাকুমেও ছিল। বেশিরভাগ বাড়িতেই ছনের ঘর ছিল। যাদের বাড়িতে টিনের ঘর ছিল তাদেরকেই পয়সাওয়ালা বলা হতো। অভাব ছিল তবে মানুষের চাহিদা কম ছিল। মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ছোটবেলায় মাছ আমরা কিনে খাইনি। নদীতে মাছ ধরতাম। বাড়ির আঙ্গিনায় সব ধরনের শাকসবজিই হতো। হাঁস-মুরগি, গরুর দুধও কিনতে হতো না। এখন তো আপনি গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য করতে পারবেন না। গ্রামের মানুষের চাহিদা আর শহরের মানুষের চাহিদার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, শিক্ষার কারণে আধুনিকতার ছোঁয়া সব জায়গাতেই লেগেছে।
মমতাজ : অনেক স্মৃতিই তো আছে। শৈশব স্মৃতিই মজার স্মৃতি। আমার দুরন্তপনা নিয়ে ভাবিরা কিছু বললেও মা তেমন কিছু বলেনি। মা প্রচুর কাজ করতেন। এখনও করেন। গ্রামের মায়েরা যেমন হয়। কাজ ছাড়া মা কিছুই বোঝেন না। কিন্তু ভাবিরা চাইতেন যে, আমি বাড়ির কাজ করি। ননদদের নিয়ে ভাবিদের যে রকম ভাবনা হয় আর কী। ভাবিরা আমাকে নিয়ে মাকে নালিশ করলেও মা পাত্তা দিতেন না। মা বলতেন, আমি তো তোমাদের দশ জনের কাজ একাই করি। আমার মেয়ে কাজ করে না তাতে হিংসা কেন। তবে একদিন মার কাছেও ধরা খেয়ে যাই। বাড়িতে অনেক মুরগির বাচ্চা ফুটেছে। আমাদের বাড়ির পাশেই বটগাছে একটি চিলের বাসা ছিল। বিকাল হলেই চিল এসে মুরগির বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত। মা ওইদিন আমাকে বলল দেখ মমতাজ, ‘আমি রান্না করছি। তুই কিন্তু আজ খেলতে যাবি না। মুরগির বাচ্চা পাহারা দে।’ মার কথা শুনে আমি বললাম দুর ছাই, আমি বাচ্চা টাচ্চা পাহারা দিতে পারুম না। এই বলেই এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। যেই না বাড়ি থেকে চলে গেছি, তখনই চিল এসে বাচ্চা নিয়ে গেছে। আর কোথায় যায়। এবার তো মায়ের পালা। বাড়িতে আসলে মা তো দিল ইচ্ছামতো উত্তম মধ্যম। বকনিরও শেষ নাই।
মমতাজ : আমি তো কান্নাকাটি করে অস্থির। আগেই বলেছি, আব্বা আমাকে খুব ভালোবাসত। আব্বা আমার নাম খুবই সুন্দর এবং শুদ্ধ করে ঢাকতেন। আব্বা রাতে বাড়িতে খেতে বসেই জিজ্ঞেস করতেন আমি খেয়েছি কিনা। আর কারও কথা জিজ্ঞেস না করলেও আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমাকে খাওয়াতেন। তো ওই দিন রাতে বাড়িতে এসে আব্বা দেখছেন যে, আমার মন খুব খারাপ। আমি কান্নাকাটি করছি। ঘটনা শুনে তো আব্বা মায়ের ওপর ভীষণ রাগ। মাকে সেই রকম বকুনি দিলেন। ওইদিনের স্মৃতি মনে একেবারে গেঁথে আছে। বাবা আমাকে কখনও বকুনি দেয়নি, মারধরও করেনি।
মমতাজ : ভাইরাও আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। এখনও তাই। শৈশবেই তো গানের দলে চলে যাই। আমি যখন পালা গান শুরু করি তখন আমার বাবা হারমোনিয়াম বাজাতেন। বড় ভাই ইউনুস আলী মন্দিরা বাজাতেন। ছোট ভাই এবারত বাঁশি বাজাতেন। অর্থাৎ পরিবারের তিনজনকেই আমি গানের দলে পেয়েছি। এ কারণে ভাইদের আদর যতœও একটু বেশি পেতাম।
মমতাজ : বাবা-মায়ের দুজনের ইচ্ছাতেই এ নাম রাখা। আমার বড় দুই ভাই হওয়ার কারণে মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল যেন পরবর্তী সন্তান মেয়ে হয়। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, আমি যখন তার গর্ভে ছিলাম তখন একদিন রাতে মায়ের কাছে আমার নামকরণ নিয়ে বাবা আলোচনা করছিলেন। মা বলছিলেন, এবার ছেলে সন্তান হলে আমি লালন পালন করব না। আমার এবার মেয়ে চাই। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তখন তো আর পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ ছিল না। বাবা তখন নাকি মাকে বলছিলেন, মেয়ে হলে নাম রাখব মমতাজ। এভাবেই গর্ভে থাকা অবস্থাতেই আমার নাম রাখা হয়। মূলত বাবার ইচ্ছাতেই এই নাম। আমি দেখেছি, বাবার মতো করে আর কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে পারেনি।
মমতাজ : দুটোতেই প্রেম, ভালোবাসা রয়েছে। মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ছিল মধুর প্রেম। আর আমার বাবা-মাও প্রেমের মধ্য থেকেই আমার নাম রেখেছেন। আমার প্রতি বাবা-মার এই প্রেম হচ্ছে বাৎসল্য প্রেম। প্রেম হচ্ছে পাঁচ প্রকার। মমতাজের মধুর প্রেমের মর্যাদা দিয়ে শাহজাহান তাজমহল গড়েছেন। আর আমার বাবা-মা বাৎসল্য প্রেমে মগ্ন হয়ে আমার নাম রেখেছেন। বাবা-মার এই প্রেমকে আমি সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের চেয়ে খাটো করে দেখি না। বাবা-মা বেঁচে থেকেই আমার নামের সার্থকতা দেখে গেছেন। বাংলার ১৬ কোটি মানুষ আমাকে ভালোবেসে যে তাজ পরিয়েছেন তার মর্যাদা কী সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের চেয়ে কম নয়। আমার গানের প্রতি গণমানুষের এই প্রেমকে আমি আরও অনেক বড় দেখি।
মমতাজ : আগে তো গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে স্কুলে যেত। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আমি ৭ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। সহপাঠীরাও আমার সমবয়সীই ছিল। গ্রামের জয়মণ্ডপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার যাত্রা শুরু। স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবা-মার তরফ থেকে যে তাগিদ ছিল বিষয়টি তা নয়। বলা যায়, অন্যের দেখাদেখি অনেকটা নিজ উদ্যোগেই স্কুলে যাওয়া শুরু করি। আগে ‘বি’ ক্লাসে পড়তে হতো। এরপর ক্লাস ওয়ানে। আমার পাশের বাড়ির এক হিন্দু ছেলে ‘বি’ ক্লাস থেকে ওয়ানে উঠল। আমি তখন তার ‘বি’ ক্লাসের বইগুলো কিনতে চাইলাম। বইয়ের দাম হলো ৭ টাকা। আমি তখন তাকে বললাম, ঠিক আছে বইগুলো আমাকে দাও, আমি স্কুলে যেতে থাকি। টাকা পরে দেব। বই নিয়ে আমি মাকে বললাম, নিকুঞ্জের কাছ থেকে বই কিনেছি। ওকে ৭ টাকা দিতে হবে। পরে মা মুরগি বিক্রি করে সেই বইয়ের দাম দেয়। এভাবেই প্রথম স্কুলে যাওয়া।
মমতাজ : স্কুলে যাওয়ার পরেই তো স্যারদের আমার প্রতি চোখ পড়ে গেল। স্যাররা বললেন, মধু বয়াতির মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ও অবশ্যই গান গাইতে পারবে। স্কুলে অনুষ্ঠান হলেই আমার ডাক পড়ত। আমারও লজ্জা-শরম একটু কম ছিল। কেউ শুনতে চাইলেই ঝটপট শুনিয়ে দিতাম। হাটে, ঘাটে, রাস্তায় কেউ গান শুনতে চাইলেই বলে ফেলতাম। কোনো বাছ-বিচার করতাম না। আগেই বলেছি, গোসল করতে গিয়ে নৌকায় উঠে মাঝিদের গান শোনাতাম। একদিন তো মাঝিরা গান শুনে খুশি হয়ে আমাদের কয়েক বান্ধবীকে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ালেন। শুধু তাই নয়, মাঝিদের একজন আমাকে ৫ টাকা বকশিশও দিলেন। গান গাওয়ার প্রথম বকশিশ।
মমতাজ : বাপরে বাপ ৫ টাকা বকশিশ। সে আনন্দ আর ধরে না। তখন ৫ টাকা মানে বিরাট কিছু। কিন্তু টাকা নিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। পরনে তো কেবল একটি হাফপ্যান্ট। টাকা রাখি কোথায়। দুই মাইল উজান থেকে নদী সাঁতরায়ে ঘাটে আসতে হবে। টাকা তো ভিজে যাবে। আমার এই বিপদ দেখে আরেক মাঝি একটি পলিথিনের কাগজ বের করলেন। পরে ওই টাকা পলিথিনে পেঁচিয়ে আমার কোমরের সুতার সঙ্গে গিট্টু দিয়ে দিলেন। এভাবেই টাকা নিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম।
মমতাজ : বাড়িতে এসে মাকে বললাম। আমি তো মহাখুশি। এর কয়েক দিন পরেই রথের মেলা। আমার টাকার গরম আর দেখে কে। রথের মেলা এলেই আমরা বান্ধবীরা চিন্তায় পড়ে যেতাম। মেলায় খরচ করব, সেই টাকার জন্য ঢেঁকি শাক, কচুর লতি, নদী থেকে কলমি শাক কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। আমরা অনেক কষ্টে দুই তিন টাকা যোগাড় করতাম। এবার রথের মেলায় তো আমার আর সে চিন্তা নেই। নগদ টাকা হাতে। মেলায় গিয়ে ৫ টাকায় অনেক কিছু কিনে ফেললাম। গান গাওয়ার টাকায় মেলায় খরচ করে অনেক মজা পেলাম।
মমতাজ : স্যারদের যে আদর, ভালোবাস পেয়েছি তা কখনও ভুলতে পারব না। আগেই বলেছি, আমরা যখন বড় হতে থাকলাম তখন পরিবারে খুব অভাব যাচ্ছিল। অনেক সময় ঘরে চালও থাকত না। না খেয়ে স্কুলে যেতাম। বাবা খাবারের চালই আনতে পারেনি সেখানে স্কুলে টিফিনের টাকা প্রত্যাশা করা অসম্ভব ছিল। বাবা অনেক সময় খাতা-কলমও কিনে দিতে পারেনি। আমাদের অভাব-কষ্ট স্যাররা জানতেন। টিফিন হলে আমিও লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু স্যাররা খুঁজে খুঁজে বের করে বলতেন, তুই আমাদের সঙ্গে টিফিন করবি। তুই কোনো লজ্জা করবি না, আমাদের সঙ্গে টিফিন করে গান শোনাবি। গান শুনিয়ে অনেকদিন স্যারদের সঙ্গে টিফিন করেছি। এ কারণেই শৈশবে স্যারদের খুব কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম। আমি কবিতাও আবৃত্তি করতে পারতাম। একবার তো কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছিলাম। আর গানের তো শেষ ছিল না। এক স্যার বলতেন, তুই লালনগীতি গাইতে পারবি। আমি বলতাম, পারব। এরপর আরেক স্যার বলতেন ভাওয়াইয়া গা। গাইতাম। গানে আমার কোনো না ছিল না। পল্লীগীতি, লালনগীতি, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ সবই গাইতাম।
মমতাজ : বাবার কাছ থেকেই প্রথম গান শেখা। বাবা প্রচুর গান গাইতেন। তবে বাবা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে আমি গান গাইতে পারব। বাড়িতে বৈঠকি গানের আসর বসত। সেখানে বাবা কিচ্ছা শোনাতেন। পাড়ার লোকজন কিচ্ছা শুনতে আসতেন। হারমোনিয়াম নিয়ে কিচ্ছা বলার মাঝে মাঝে অনেক গান গাইতেন। আমি বাবার পাশে বসতাম। পরে বাবাও আমাকে তার সঙ্গে সঙ্গে গান ধরতে বলতেন। বাবাই আমার গানের প্রথম ওস্তাদ।
মমতাজ : আমি পড়ালেখাতেও ভালো ছিলাম। প্রাইভেট পড়তাম না। বাড়িতেও কেউ আমাকে পড়াতেন না। এরপরেও পড়ালেখায় খুব খারাপ ছিলাম না। স্কুলের স্যারদের সহযোগিতা পেয়েছি।
মমতাজ : স্কুলে আমার কোনো বিকল্প ছিল না। গানে আমি সবসময় প্রথম হতাম। স্কুলগুলোর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষে নির্বাচিতদের নিয়ে সিঙ্গাইর উপজেলায় একবার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। স্কুল থেকে আমাকে সেখানে পাঠানো হয়। এরশাদের আমলের ঘটনা। আমাদের আসনের জাতীয় পার্টির এমপি গোলাম সারওয়ার মিলন তখন মন্ত্রী। অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি। উপজেলা চেয়ারম্যানও ছিলেন। এই প্রথম এত মানুষের সামনে গান করছি। প্রথম গান গাওয়ার পর দর্শকরা অনুরোধ জানিয়ে বললেন, যে মেয়েটি গান করছে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ওকে টেবিলের ওপরে উঠানো হোক। আমি একেবারেই পিচ্চি ছিলাম। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। দর্শকদের অনুরোধে তাই হলো। টেবিলের উপরে উঠে গান গাইলাম। গানে দর্শকরা মুগ্ধ। মন্ত্রী গোলাম সারওয়ার মিলন আমাকে দুই হাজার টাকা বকশিশ দিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান দিলেন পাঁচ শত টাকা। ওই অনুষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো বকশিশ পাই। ওই সময় তিন হাজার টাকা আমার জন্য অনেক বড় কিছু। স্যারদের কারণেই আমার এমন প্রাপ্তি। ওই দিনও আমার সঙ্গে এক স্যার ছিলেন।
মমতাজ : আমার তো সবসময় গান গাওয়াই ভালো লাগত। বাবা মঞ্চে গান করতেন। বাবার সঙ্গে অনেকেই গান গাইতেন। মাইকে ক্যাসেট বাজত, তা দেখে মনে মনে খুব ইচ্ছা জাগত যে, কোনো দিন যদি আমি এভাবে গান গাইতে পারতাম। মঞ্চে উঠে মাইকে উচ্চৈঃস্বরে গান করব এমন ইচ্ছা ছোট বেলা থেকেই লালন করতাম। গানের প্রতি এই মুগ্ধতা এবং ভালোবাসা থাকার কারণে হয়ত পড়ালেখার স্বপ্নটা ক্রমেই ফিকে হতে থাকে। তবে বুঝতাম যে পড়ালেখা ছাড়া জীবনে বড় কিছু হওয়া যায় না। কিন্তু এটি বোঝার পরেও গানের প্রতি ভালোবাসা কমাতে পারিনি।
মমতাজ : সত্যি কথা বলতে কী, পরিবারে অভাব ছিল বটে কিন্তু আমি যে ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি তা হয়ত অনেকেরই নেই। মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, আমি তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের অসাধারণ ভালোবাসা পেয়ে আসছি। জীবনে অনেক স্টেজ পার করেছি। কিন্তু সব জায়গাতেই মানুষ আমাকে অতি ভালোবাসা দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুরা থেকে শুরু করে গানের আসর, বাউল জগৎ, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সমস্ত জায়গায় মানুষ আমাকে খুব কাছে থেকে মূল্যায়ন করে। মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য আমিও আন্তরিক। মানুষের সঙ্গে মিশতে আমার মধ্যেও কোনো জড়তা কাজ করে না। সব শ্রেণীর মানুষ আমাকে যেভাবে সাড়া দেয় তার চেয়ে বড় কোনো অর্জন আছে বলে আমার জানা নেই। ছোটবেলার বন্ধুদের যে ভালোবাসা তার তো তুলনা হয় না।
মমতাজ : আমি ঢাকায় থাকলেও গ্রামের বাড়িতে অনেক সময় কাটে। আগে তো গ্রামেই থাকতাম। মা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। এখন ব্যবসা, রাজনীতির কারণে গ্রামে যেতেই হয়। গ্রামে গেলে শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, সাক্ষাৎ হয়। আমি প্রায় সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। অনেক বন্ধুই পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করছেন। তারাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
মমতাজ : স্কুল জীবনে যে শিক্ষকদের কাছাকাছি ছিলাম তারা এখনও অতি আপন বলেই আমাকে মূল্যায়ন করে থাকেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। স্যারেরা কোনো বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসতে দ্বিধা করেন না। আমি তো তাদেরই মমতাজ। যে দু’জন শিক্ষক আমাকে নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন তারা হচ্ছেন আব্দুর রশিদ এবং আদম আলী স্যার। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তারা। রশিদ স্যারকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। আপনি আসার আগেও রশিদ স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, মা তুই এবার নির্বাচন কর। এলাকার গরিব, দুঃখী মানুষের পাশে তোকেই দাঁড়াতে হবে। আমরা তোর নির্বাচন করব। আমার জন্য এটিই আশার কথা। স্যারদের আশীর্বাদ নিয়েই তো পথ চলছি।
মমতাজ : তখন শ্যামলীতে থাকতাম। আমি একেবারেই পিচ্চি। বাবা নিয়মিত মিরপুরে খাজা বাবার মাজারে গান করতে যেতেন। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে বাউলদের গানের আসর বসে। একদিন আমি বাবার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরি। ফিরতে অনেক রাত হবে বলে বাবা আমাকে নেবে না। পরে মায়ের অনুরোধে বাবা আমাকে শাহ আলী বাবার মাজারে নিয়ে যায়। আমার বাবা, ওস্তাদ মালেক সরকার, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, ইসলাম সরকার গান করছেন। আমি ওস্তাদ ইসলাম সরকারের কাছে বসা। অনুষ্ঠানের মাঝে ওস্তাদ ইসলাম সরকারের কাছে বায়না ধরলাম, কাকা আমি গান গাইব। কাকা বলছেন তুমি গান জানো? আমি বললাম, পারব। তখন ইসলাম কাকা বাবাকে বললেন, ভাই ভাতিজি যে গান গাওয়ার বায়না ধরছে। বাবা তো ধমক। বাবা বলেন, ও গান জানে নাকি। পারবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। পরে ইসলাম কাকা দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, আমাদের মধু বয়াতির পাঁচ বছরের মেয়ে মমতাজ আপনাদের গান শোনাবে। দর্শকদের হাতে তালি। যন্ত্রের সঙ্গে তাল, লয় ঠিক রেখে গাইলাম। কোনো ভুল হয়নি। সবাই তো অবাক। দর্শকরা মহাখুশি। প্রচুর টাকা বকশিশ পেলাম। দু’হাত টাকায় ভরে গেল।
মমতাজ : ইসলাম কাকা বাবাকে বললেন, মেয়ের সাহস দেখেন। ও পারবে। আপনি ওকে গান শেখান। তখন বাবা বললেন, বাড়ির গরু তো পালানের ঘাস খায় না। আমি গান ভালো করতে পারি বটে, কিন্তু ওস্তাদ ভালো নাও হতে পারি। আমি তো সময় দিতে পারব না। তখন ইসলাম কাকাই বাবাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, একমাত্র মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানই পারে মমতাজকে গান শেখাতে। সে যেমন গায় তেমন শেখায়। মমতাজকে তার কাছে দিয়ে দেন।
মমতাজ : হ্যাঁ, পরের দিন বাবা মাজারে গিয়ে দেওয়ানের সঙ্গে কথা বললেন। মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান সবসময় নেশায় মগ্ন থাকত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার নেশা করা শুরু হতো। রাজ্জাক দেওয়ান আমার বাবাকে কাকা বলে ডাকতেন। তিনি হচ্ছেন খালেক দেওয়ানের শিষ্য। আর বাবা ছিলেন খালেক দেওয়ানের আরেক শিষ্য ইউসুফ দেওয়ানের ছাত্র। ইউসুফ দেওয়ানকে বাবা চাচা বলতেন বলেই রাজ্জাক দেওয়ানও বাবাকে চাচা বলতেন। পরে আলোচনার এক পর্যায়ে বাবা রাজ্জাক দেওয়ানকে বললেন, আমি তো মমতাজকে গান শেখাতে চাই আর সে দায়িত্বটা আপনাকেই নিতে হবে। রাজ্জাক দেওয়ান বললেন, আপনার মেয়ে গান শিখবে, সে তো ভালো কথা। ওকে অবশ্যই গান শেখাব। এই তো শুরু হলো গান শেখার পালা।
মমতাজ : ওই দিন তো ছিল আমার জীবনের একটি ইতিহাস। দু’হাতের মুষ্টিভর্তি টাকা। আনন্দ দেখে কে। বাবাকে বললাম, আমাকে একটি মাটির ব্যাংক কিনে দিতে হবে। টাকা দিয়ে এই করব, ওই করব কত পরিকল্পনা যে মাথায় চলে এলো তা বোঝানো যাবে না। গানের প্রতি উৎসাহও বেড়ে গেল।
মমতাজ : ছোটবেলায় তো অতসব বুঝতাম না। বাবার গান ভালো লাগত। বাবা যখন যে ঢংয়ে গান গাইতেন তখন সেটাই আমার কাছে ভালো লাগত। এলাকায় অনেক যাত্রা গান হতো। বাবাকে যাত্রা পালায় বিবেকের গান গাইতে দেয়া হতো। মেকআপ রুম থেকেই বাবা সুর ধরে মঞ্চে উঠতেন। সুর ধরলেই মানুষ বুঝতে পারতেন যে মধু বয়াতি গান গাইছেন। বাবার কণ্ঠে অসাধারণ পাওয়ার ছিল। যাত্রাপালার মাঝখানে বাবা যখন বাউলের বেশে সত্য কথা নিয়ে বিবেকের গান ধরতেন তখন নিজের মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করত। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যেত। একইভাবে দাদার গানেও উৎসাহ পেতাম। ভাবতাম এইভাবে যদি আমিও গাইতে পারতাম।
মমতাজ : বাবা অনেক সময় মানা করতেন। বলতেন, সারা রাত যাত্রাপালা দেখে এসে দিনে কোনো কাজ করবে না, পড়াশোনা করবে না। যাত্রা দেখার কোনো দরকার নেই। কিন্তু আমরা শুনতাম না। বাবা চলে যাওয়ার পরেই ভাইয়ের সঙ্গে চলে যেতাম। যাত্রা শুরু হলে চুপিচুপি প্যান্ডেলের কাছে যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন তাদের কাছে গিয়ে বসতাম। বলতাম, কাকা একটু জায়গা দেন বাবা যেন না দেখে। কিন্তু মঞ্চে উঠেই বাবা টের পেতেন যে, আমি বাঁশিওয়ালা কাকার কাছে বসে আছি। তখন আর কিছু বলতেন না। যাত্রাপালা আমার খুব প্রিয় ছিল।
মমতাজ : সে সময় তো মানুষ মুগ্ধ হয়ে যাত্রা দেখত। তখন একটি নাচ শুরু হলেই দর্শকরা প্রতিবাদ করত। আর এখন যাত্রার নামে কেবল নর্তকী নাচানো হয়।
এখন তো মানুষ গানবাজনার অনুষ্ঠানে যেতে পারে না। আগে দেখতাম যাত্রা অনুষ্ঠানে অর্ধেক মহিলা দর্শকও থাকতেন। এখন আর সে পরিবেশ নাই। মহিলারা আর কোথাও গান শুনতে যেতে পারছেন না।
মমতাজ : যে কোনো বিষয় নিয়েই মানুষের মাঝে নেগেটিভ, পজিটিভ ধারণা কাজ করে। তখনও ছিল, এখনও আছে। মিডিয়ার এত প্রসারের পরেও মানুষ নেগেটিভ ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। বিষয়টি এমন যে, কেউ একজন গান খুব পছন্দ করেন কিন্তু তার মেয়ে বা বোন গান করবেন তা মেনে নিতে পারেন না। সমাজের অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন। আবার কেউ সমালোচনাও করতেন। এই বাধা যে অতিক্রম করতে পারে কেবল তারাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। বাধা আসবেই। তাকে জয় করাই হচ্ছে সার্থকতা।
মমতাজ : হ্যাঁ, সমাজের অনেকেই তো সহযোগিতা করেছেন। যারা মাতব্বর ছিলেন, তাদের অনেকেই বাবার গান পছন্দ করতেন। আমার ছোটবেলার গানে তারাও উৎসাহ দিতেন। তাদের আশীর্বাদ এবং সহযোগিতার কারণেই এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
মমতাজ : আমার মায়ের নাম উজালা বেগম। মা জীবনে খুবই কষ্ট করেছেন। বাবা ছিলেন উদাসীন। সংসারের সবকিছু মাকেই করতে হতো। তবে বাবার বাউল জীবন নিয়ে মা কখনও বিরক্ত হননি বরং অনেক পছন্দ করতেন। এক সময় আমিও বাউল জীবনে চলে গেলাম। আমার জন্য মায়ের কষ্টটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার এ পর্যায়ে আসার জন্য বাবার থেকে মায়ের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়।
মমতাজ : ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান যখন আমাকে গান শেখাতে আসতেন তখন মা-ই তার সেবাযতœ করতেন। ওস্তাদ প্রচুর পান খেতেন। আমার মাও পান খায়। কিন্তু মা খুব পরিপাটি একজন মানুষ। মা এখনও আমার চেয়ে অনেক গোছানো। বাবাও খুব পরিপাটি ছিলেন। বাবা নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করতেন। একেবারে সাদা কাপড় পরতেন। ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ান যখন বাড়িতে আসতেন তখন পানের পিকে পুরো বাড়ি ভরে যেত। মা পিক ফেলানোর বাসন দিলেও ওস্তাদের সেদিকে খেয়াল থাকত না। কিন্তু আমার ওস্তাদকে নিয়ে মা কোনোদিন বিরক্ত হননি।
আবার অনেক সময় দেখা গেছে, বাড়ি থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে কোনো গানের অনুষ্ঠান গান গাইতে হবে আর তখন আমি পায়ে হেঁটে যেতে চাইতাম না। রিকশা, ভ্যানও ছিল না। তখন মা আমাকে কোলে করে নিয়ে গানের আসরে রেখে আসতেন। আমার ওস্তাদ যখন গান শেখাতে আসতেন মা তখন তার গোসল থেকে শুরু করে সবই করতেন। শীতকালে পানি গরম করে দিতেন। গরমকালে সারাক্ষণ পাখার বাতাস করতেন। শিষ্য হিসাবে যা আমার করার কথা তা আমার মা করতেন। আমি এগুলো বুঝতামও না, অভ্যাসও ছিল না। মা নিজেই সেবাযতœ করে ওস্তাদের কাছ থেকে আমার জন্য কাজ আদায় করে নিতেন। লোকে বলত, সন্তানের জন্য মহিলা কত কষ্ট করছে। মূলত বাবার কাছ থেকে শুরু হলেও মায়ের পরিশ্রমের কারণেই শিল্পী মমতাজ হতে পারছি।
মমতাজ : বাউলদের হিংসা থাকে না। বাবাও তাই ছিলেন। কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না। কারও সঙ্গে ঝগড়াও করতেন না। বাবা একেবারে নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বাবার কাছ থেকে কেবল ভালোবাসা আর আদরই পেয়েছি আমরা। কখনো চড়াও হতে দেখিনি। বাবা ছিলেন একজন সহজ-সরল ভালো মানুষ। বড় ধরনের কোনো চাহিদাও ছিল না তার।
মমতাজ : বাবার সঙ্গে পালা গানের অনুষ্ঠানে যাই। গভীর রাত পর্যন্ত পালা গান চলত। আমি তখনও পালা গান করি না। পালা শুনতে শুনতে এক সময় দর্শকরা ভাবের গান অর্থাৎ মুশির্দী, বিচ্ছেদ গান শুনতে চাইতেন। তখন বাবা বলতেন আমি তো পালা করলাম, এবার আমার মেয়ে গান গাইবে। ও ভালো গায়। ওর গান শুনুন। রাত তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে গান গাওয়া লাগত। দয়ালের গান, মুর্শিদের গান শুনে তো মুরুব্বি দর্শকরা কান্নাকাটি করে অস্থির। গানের সময় আমিও কাঁদতাম। বাবার সঙ্গে থাকা এক দোহারী আমাকে একদিন বললেন, ‘তুই পিচ্চি মাইয়্যা। তুই দয়াল, মুর্শিদের কী বুঝিস। মুরুব্বিরা কান্না করে ঠিক আছে। তুই কান্না করস ক্যান।’ আমি তখন বললাম, কান্না করুম না ক্যান। রাত তিনটার সময় আমারে ঘুম থেকে তুইল্যা গান করতে কইব্যা, আমার বুঝি কষ্ট হয় না। এত রাতে গান করলে খিদাও লাগে, ঘুমও লাগে। এই দুঃখেই তো কান্না করি।’ আমি ঘুমের জন্য কাঁদতাম। আর দর্শকরা মনে করতেন নিজের গানে মত্ত হয়ে নিজেই কাঁদছি। কী যে হাস্যকর ঘটনা তা বলে বুঝানো যাবে না। গান শেখা, গাওয়ার ক্ষেত্রে এরকম তো অনেক ঘটনাই আছে।
মমতাজ : ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান অনেক সহজভাবে আমাকে গান শেখাতেন। বাবার সঙ্গে যখন পালা গান করতাম তখনও রাজ্জাক দেওয়ানের শেখানো পদ্ধতিই অনুসরণ করতাম। যেমন, গুরু-শিষ্যের পালা যখন হতো, তখন আমি শিষ্যের পালা নিতাম। স্রষ্টা এবং জীবের মধ্যে পালা হলে আমি জীবের পালা নিতাম। একইভাবে শরিয়ত-মারফত পালার সময় আমি শরিয়ত পালা নিতাম। কারণ, মারফতের অনেক গোপন তথ্য জানতে হয়। আমি অত যুক্তি, প্রশ্ন জানতাম না। ওস্তাদ আমাকে যে প্রশ্নগুলো লিখে দিত তার মধ্য থেকেই জেরা করতে হতো। যে পালাগুলো সহজ ছিল সেই পালাগুলো আমাকে দেয়া হতো।
মমতাজ : বাবা একেবারে কাছে ছিলেন বলেই আমি পালা গান শিখতে পেরেছি। বাবার যখন বয়স হয়ে গেল তখন পালার মধ্যে গানগুলো আমাকেই করতে হতো। বাবা যুক্তিতর্কে ভালো করতেন কিন্তু আমি গান ভালো করতাম। যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো করেছি।
মমতাজ : আমি তখন একটু একটু পালা গান শিখতেছি। একদিন শুনতে পেলাম যে, আমাদের মানিকগঞ্জের পুটাইল নামের এক জায়গায় পালাগানের আসর বসবে। গাইবেন বিখ্যাত বাউল শিল্পী রশিদ সরকার এবং আলেয়া বেগম। রশিদ সরকার তখন সারাদেশের হাতেগোনা চার-পাঁচ জন পালাগান শিল্পীর মধ্যে একজন। সারা দেশেই এক নামে পরিচিত। আমি বাবাকে বললাম যে, চলো গান শুনতে যাব। দিনের বেলায় গান। গিয়ে রশিদ সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তার বাড়ি সিঙ্গাইর সদরে। বাবার সঙ্গে অনেক গান করছেন তিনি। আমাকে দেখে বাবাকে বললেন, ওকে নিয়ে এসেছেন ভালোই হয়েছে। গান শুনতে পারবে। আমরা গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। মানুষে মানুষে মাঠ কানায় কানায় ভরে গেছে। বেলা বাড়ছে কিন্তু আলেয়া বেগম আসছে না। দর্শক তো গান শোনার জন্য চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে রশিদ সরকার মঞ্চে উঠে দর্শকরদের উদ্দেশে দু’টি গান করে বললেন, আমাদের পালাগানের আরেক শিল্পী আলেয়া বেগম এখনও আসতে পারেনি। আপনারাই বলুন, কী করা যায়। তখন তো মোবাইলও ছিল না যে ফোন করে খোঁজ নিতে পারবে। শিল্পী আসেনি এই কথা শুনে তো দর্শক আরও অস্থির। তখন রশিদ সরকার বাবাকে বললেন, আপনি মমতাজকে পালা শেখাচ্ছেন। ও কি গাইতে পারবে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, ওনাকে গুরু-শিষ্য নিতে বলো। শিষ্যের পালা হলে আমি গাইতে পারব। তখন রশিদ সরকার মঞ্চে উঠে দর্শকদের বললেন, আলেয়া যেহেতু আসেনি আর আসবে কিনা তা বলাও যাচ্ছে না, তাই বিকল্প ভাবতে হচ্ছে। আপনারা চাইলে ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে আমি গাইতে চাই। ও মধু বয়াতির মেয়ে মমতাজ। গান শিখছে। আমরা গুরু-শিষ্যের পালা করব। দর্শকরা আপাতত শান্ত হলো।
মমতাজ : রশিদ সরকার অনেক জানতেন। কিন্তু আমি তো ভালো গান করতাম। মঞ্চে উঠে শুরু করলাম। আমার ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা গান। গানে অনেক প্রশ্ন। তো একপর্যায়ে রশিদ সরকার বলে ফেললেন, তোমার এক গানের প্রশ্নের উত্তর দিতে দফারফা। তিনি খেপে গেলেন। পাবলিক তো মহাখুশি। রশিদ সরকারের মতো বাউলকে খেপিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি তখন বললাম, পারলে উত্তর দেন। না পারলে বলেন যে, জানি না। তখন সে আরও উত্তেজিত। বললেন হ্যাঁ, রশিদ সরকার পারবে না এমন কোনো বিষয় আছে? এরকম টান টান উত্তেজনা নিয়েই গান শেষ করলাম। দর্শক বলতে শুরু করল, রশিদ সরকারে মতো শিল্পীর সঙ্গে মধু বয়াতির মেয়ে গান করল। এতো বিশাল ব্যাপার। পরে রশিদ সরকার বাবাকে বললেন, ও তো ভালো গায়। শ্রম দিন। পারলে আমিও সহযোগিতা করব। এভাবেই রশিদ সরকারের সঙ্গে পালাগানে জুটি বাঁধা।
মমতাজ : মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের বাড়ি ছিল কেরানীগঞ্জের আটিবাজার। আমি যখন তার কাছে গান শিখি তখন তিনি থাকতেন সাভারের কাছে আমিনবাজারে। আমিনবাজারে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই তিনি থাকতেন। মূলত মিরপুর শাহ আলী বাবার মাজার কাছে হওয়ার কারণেই তিনি আমিনবাজারে থাকতেন। ওস্তাদ মিরপুর বাউল সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। আমি আমিনবাজারেই তার কাছে গান শিখতাম। যখন শীতকাল অর্থাৎ গানের প্রোগ্রাম আসত তখন তিন, চার মাস তার কাছেই থাকতাম। শীত চলে গেলে বাড়িতে চলে যেতাম। ওস্তাদ আবার মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে এসে আমাকে গান শেখাতেন। মাতাল রাজ্জাকের সঙ্গে এভাবেই থাকা।
মমতাজ : আমি তো গানই শুরু করেছি বিচ্ছেদ, মুর্শিদী দিয়ে। যেমন, বিজয় সরকারের বিজয় বিচ্ছেদ ভালো গাইতাম। রজব আলী দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ানের গান করতাম। লালনগীতি গাইতাম। পাঞ্জুশাহ, জালান উদ্দিন খা, রশিদ উদ্দিনের গান অনেক গেয়েছি। এরকম বড় বড় সাধকদের গান করতাম।
রশিদ সরকার, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, আমার বাবার মতো বড় বড় বাউলের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। সুতরাং তাদের থলিতে যা ছিল সবই আমাকে উজাড় করে দিয়েছেন। রশিদ সরকার কোনো নতুন গান গাইলেই আমি ডায়েরিতে নোট করে রাখতাম। আর ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের ডায়েরি তো আমার কাছেই থাকত। রাধাবল্লভ, রাধারমনের গান ভালো লাগত।
মমতাজ : দর্শকরা আমার বিচ্ছেদ গান খুব পছন্দ করত। রাজ্জাক দেওয়ান, রশিদ সরকার এবং আমার বাবার কাছ থেকে নেয়া বিচ্ছেদগুলোই আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
মমতাজ : হ্যাঁ। যেমন, রশিদ সরকার আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। কেউ গানের জন্য বায়না করতে এলে সরকার বলতেন, ভালো গান শুনতে চাইলে আরেকটি মেয়েকে বায়না করেন। তখন আমার নাম বলতেন। বায়নাকারীরা বলতেন, ওস্তাদ যে কী বলেন। কোথায় আপনি আর কোথায় মধু বয়াতির মেয়ে মমতাজ। তখন আবার রশিদ সরকার বলতেন, দেখুন আমি আপনাদের তথ্যের খোরাক মেটাতে পারব। তবে গানের খোরাক মমতাজই ভালো মেটাতে পারবে। আগেই বলেছি, রশিদ সরকার অনেক বেশি জানতেন। তাকে পাল্লা দিয়ে কেউ পালাগান করবে এমন সাহস কারও ছিল না। তিনি ভালো লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। কিন্তু এরপরেও তিনি আমার গানের প্রতি দুর্বল ছিলেন। একইভাবে রাজ্জাক দেওয়ানও আমাকে সহযোগিতা করেছেন। বায়নাকারীদের বলতেন, ‘আমার লগে কারে লইবি। রশিদ সরকাররে। ও ছোঁড়া তো খালি ঝগড়া করব। তোরা ঝগড়া শুনবি নাকি গান শুনবি। গান শুনতে চাইলে আমার লগে এই মাইয়্যারে ল। তোগো ভালো লাগব। ভালো না লাগলে টাকা দিস না।’ ওস্তাদ পালায় বকাঝকা করতেন। সুর ভাঙা ভাঙা ছিল। তবে ভালো লিখতেন। ওস্তাদরা এভাবেই আমাকে এগিয়ে দিয়েছেন।
মমতাজ : সিনিয়র ওস্তাদদের সঙ্গে কোনো প্রোগ্রামে গেলে সেখান থেকে আরও দশ জায়গার বায়না আসত। তখন আমিও বলতাম ‘রশিদ সরকার, রাজ্জাক দেওয়ান, পরশ আলী দেওয়ান হলে আমি গান করব। সিনিয়রদের লগে নেন। আমিও পোলাপান। আবার পোলাপানদের লগে কী গান করুম।’ আমাকে নেয়ার জন্য তখন সিনিয়র ওস্তাদদের নিতে বাধ্য হতেন।
মমতাজ : এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয়নি। যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখনই প্রতিষ্ঠিত পালাগান শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে রশিদ সরকারের সঙ্গে পালাগান করছি। তাহলে বুঝতেই পারছেন কত ব্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রতিনিয়ত পালা থাকত। টাকা পয়সা আসতে শুরু করল।
আগে তিন হাজার টাকা দিয়ে বায়না করা হতো। আর আমি শুরুই করেছি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। এরপর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়িয়ে বললাম, আমাকে নিতে হলে দশ হাজার টাকা লাগবে।
মমতাজ : হ্যাঁ, পুরো টিমের জন্যই এই টাকা।
মমতাজ : তাই তো হলো। বাবা গান ছেড়ে দিলেন। পরিবারের অবস্থাও ভালো ছিল না। পুরো পরিবার আমার ওপর নির্ভর করতে লাগল। ধীরে ধীরে গানের জগতেই ঠাঁই মিলল।
মমতাজ : সে কষ্ট ভোলার নয়। আমি তো এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি যে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। আবার কখনও কখনও স্বপ্ন দেখি যে, পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু গানের আসরে আছি। বই ব্যাগে করে নিয়ে গেছি কিন্তু পড়তে পারিনি। পরীক্ষার হলে সবাই লিখতেছে। আমি পারছি না। এই স্বপ্নগুলো এখনও তাড়া করে বেড়ায়। সত্যি কথা বলতে কি, আমি স্কুলে ভালো ছাত্রী ছিলাম। একবার পড়লেই মনে থাকত। আসলে পড়ালেখা কপালে ছিল না। কী আর করা।
মমতাজ : অন্য কোনো কারণ ছিল না। কেবল গানের প্রতি মনোযোগ থাকার কারণেই পড়াশোনা করতে পারেনি। পালাগান করতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ধরুন, শরিয়ত-মারফত নিয়ে আগের দিন পালাগান করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে হয়ত প্রতিপক্ষের কোনো মারফতি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর দিতে না পারার পর থেকেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত। বাড়িতে এসে পবিত্র হাদিস, কোরান নিয়ে বসে পড়তাম। কোন সূরা, কোন হাদিস থেকে প্রশ্নটি করা ছিল তা খুঁজে বের করতে অস্থির হতাম। ওই সময় বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, মেসকাত শরীফ পড়তে শুরু করলাম। গিরিশ চন্দ্র সেনের কোরানের তরজমাসহ নানা তাফসীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। পালাগানে কেউ বলবে যে, কেবল দুটি গান গাইলেই বয়াতি হওয়া যায় না আর এই কথা শুনতে আমার ভালো লাগত না। প্রশ্নের জবাব বের করার জন্যই কোরান হাদিস নিয়ে বসে যেতাম। পাঠ্যবই রেখে ধীরে ধীরে হাদিস কোরানের দিকে জোর দিতে থাকলাম।
মমতাজ : তা তো অবশ্যই ছিল। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পড়াশোনা করতে গেলে তো জানাই হয়। আমি দেখেছি, সাঁইজিরা হাদিস-কোরানের মধ্য থেকে কথা বলতেন। তারা বলতেন, কোরান যত পড়বে ততো জানবে, শিখবে, নিজের মধ্যে আলো পাবে। আপনি যতবার কোরান শরীফ পড়বেন ততো জ্ঞানী হবেন। একবার, দুইবার পড়ে বুঝতে পারবেন না। অনেক জন অনেকভাবে কোরান হাদিস ব্যাখ্যা করেছেন। সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করে নিজের উত্তর বের করা অনেক কঠিন কাজ ছিল।
মমতাজ : কোন সূরা কখন, কীভাবে, কেন নাজিল হলো সে সম্পর্কে জানতে হতো। সাহাবীদের জীবনী, পীর-মাশায়েখদের জীবনী নিয়ে বিশদ পড়াশোনা করতে হতো। শরিয়ত-মারফত নিয়ে কথা বলতে হলে আপনি না জেনে তো বলতে পারবেন না।
সাপ্তাহিক : হাদিস কোরানে শরিয়ত-মারফতে মৌলিক কী পার্থক্য পেলেন?
মমতাজ : কোরান হাদিসের আলোকে আপনি যা করছেন অর্থাৎ যা দেখা যাচ্ছে তাই শরিয়ত। আর মারফত হচ্ছে, দু’চোখে যা দেখা যায় তারও বাইরে কিছু অনুভব করা অর্থাৎ অন্তর চক্ষু দিয়ে উপলব্দি করাই হচ্ছে মারফত বা গোপনীয় বিষয়। আল্লাহর ওলী, পীর, মাশায়েখরা তো গোপন এবাদত করেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে হলে আপনাকে অন্তর চক্ষু দিয়ে কোরান হাদিস বিশ্লেষণ করতে হবে। স্রষ্টার ওপর আলোচনা আপনি এমনিই করতে পারবেন?
মমতাজ : অতি কঠিন একটি বিষয়। এক কথায় বলতে গেলে খোদায়ী শক্তির ওপর বিশ্বাস তো রাখতেই হবে। এই মহাসত্তাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু হঠাৎ করে ধর্ম নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক না। হুজুর পাক (স.) যে বিধান আমাদের জন্য রেখে গেছেন সেই বিধান অনুযায়ী চলতে পারলেই মুক্তি। এবাদত বন্দেগী করতে করতেই মানুষ কামেল হয়। সেই লেভেলে গিয়ে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করা যায়। যেমন, মুনসুর হেল্লাজ। তিনি এবাদত-বন্দেগী বা জানতে জানতে এমন এক পর্যায়ে গেছেন যখন তিনি নিজেকে আয়নাল হক অর্থাৎ খোদা দাবি করেছেন। সব কিছুর একটি পর্যায় লাগে। তবে ধর্ম নিয়ে অতিকথা না বলাই ভালো। ধর্মে অবশ্যই বিশ্বাস করি তবে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করি না।
মমতাজ : এক শ্রেণীর মানুষ তো সারা জীবনই এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকেন। আমরা হাদিস কোরানের আলোকে যত যুক্তিতর্কই উপস্থাপন করি না কেন তারা কোনোদিনই তা বরদাস্ত করেনি এবং করবেনও না। ওই সময় তো আরও জটিল অবস্থা ছিল। পালাগান মূলত ফকিরি বাড়ি, মাজারে হয়ে থাকে। মৌলভী, মুন্সিরা সাধারণত এসব পছন্দ করেন না। এ কারণে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। অনেক সতর্ক থেকে কথা বলতে হয়েছে। তবে আমি দেখেছি, যারা পছন্দ করেন না তারা বেশি পড়াশোনা করেন বলেও মনে হয়নি।
মমতাজ : যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারাই তো আনন্দের। অনেক ভালো লাগত। বড় বড় মাওলানার সঙ্গে বাহাস করা অনেক বড় বিষয়। দেখেছি, ওস্তাদরা দিনের পর দিন কোরান, হাদিস ঘেঁটে মাওলানাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অনেক জানা হয়ে যেত।
মমতাজ : সুফিবাদে হিংসা, বিদ্বেষ যেমন থাকে না তেমনি বাউলদের জীবনেও হিংসার কোনো ঠাঁই নেই। আমার দৃষ্টিতে দুটো একই। বিশেষ কোনো তফাৎ আছে বলে মনে হয় না। সুফিরা স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে বলেন। বাউলরা তাই করেন। বাউলদের গানে মানবমুক্তির কথাই বলা হয়। ইসলামের মৌলিক কথাও তাই। মানুষের কল্যাণই মানুষের আসল ধর্ম।
মমতাজ : আসলে ওইদিনই তার সঙ্গে গান করা। এরপরে তো তার পরামর্শে ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের কাছে গান শিখলাম। ইসলাম সরকার শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। মাথায় টিউমারের মতো কিছু একটা ছিল। কিন্তু ডাক্তারের কাছে তাকে চিকিৎসা নিতে দেখিনি। মাথার ওই সমস্যার কারণেই অল্প বয়সে তিনি মারা যান। তবে ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ানের সঙ্গে তিনি অনেক গান করতেন।
মমতাজ : তার কাছে মূলত পালাগান শিখতাম। আর বিচ্ছেদ তো আমার বাবার কাছেই শিখেছি। সাপ্তাহিক : রশিদ সরকার?
মমতাজ : রশিদ সরকার আমাকে নিয়ে মঞ্চে গান করতেন। শেখা আমার রাজ্জাক দেওয়ানের কাছেই। রশিদ সরকার অনেক বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। তার সঙ্গে গান করে ব্যাপক প্রচার হতো।
মমতাজ : বার চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই রশিদ সরকারের সঙ্গে নিয়মিত পালা গান করতাম।
মমতাজ : ওস্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। রশিদ সরকারের সঙ্গে গান করার সময় রাজ্জাক দেওয়ানের সঙ্গেও গান করেছি। সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল। দু’জনই আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গানের বায়না নিতেন। এর মধ্যে আমারও একটি জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। আমার কাছেও গানের বায়না এলে সুবিধা মতো কখনও রশিদ সরকার আবার কখনও রাজ্জাক দেওয়ানকে বায়না করতে বলতাম।
মমতাজ : অল্প বয়সেই তার সঙ্গে বিয়ে হয়। বলতে পারেন বাল্যবিয়ে। রশিদ সরকারকে যখন বিয়ে করি, তখন আমার বয়স ১৫ কি ১৬ বছর হবে।
মমতাজ : রশিদ সরকারের সংসার জীবনের চেয়ে তার সঙ্গে গানের জীবনই আমার মধুর ছিল। আসলে সংসার জীবনে রশিদ সরকারকে তেমন একটা সময় দেয়া হয়নি। আমি তার সঙ্গে গান করতাম। ১৫/১৬ বছর বয়সে তার সঙ্গে নানা জায়গায় গান করতে যেতাম। লোকে মন্দ বলত বলেই দু’জনের সম্মতিতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া। আমার ইচ্ছা ছিল বড় শিল্পী হওয়ার। আর এ কারণেই হয়ত তাকে বিয়ে করা। আমার বয়স ছিল ১৬ আর তার বয়স ছিল ৪৫। ফলে স্বামী, সংসার কী তা আমার কাছে তেমন গুরুত্ব পেত না। এর চেয়ে তাকে ওস্তাদ হিসেবেই বেশি গুরুত্ব দিতাম।
মমতাজ : এরকম বিষয় কেউই ভালোভাবে নিতে চায় না। রশিদ সরকারের আগের স্ত্রীর বেলাতেও তাই হয়েছে। রশিদ সরকার ছিলেন পীর মানুষ। বড় সংসার ছিল। সারা দেশে হাজার হাজার মুরিদ ছিল তার। তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সেই তুলনায় আমি ছিলাম খুবই নগণ্য। সঙ্গত কারণে তার পরিবার বিষয়টি মানতে পারেনি।
মমতাজ : আমি আমার বাবার বাড়িতেই থাকতাম। রশিদ সরকারের বাড়ি যাওয়া হয়নি। তবে বিয়ের পর রশিদ সরকারের সঙ্গেই গান করতাম।
মমতাজ : আগেই বলেছি, বাবা গান ভালো গাইতেন। কিন্তু তত্ত্বশাস্ত্র মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান বা রশিদ সরকারের মতো পারতেন না। বাবা ছিলেন অলরাউন্ডার। সবকিছুতেই কিছু কিছু পারদর্শিতা ছিল। বাউল গান গাইতেন, যাত্রা মঞ্চে বিবেকের গানও গাইতেন আবার নৌকা বাইচ খেলায় নৌকাতেও গান করতেন। নৌকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে যখন উচ্চৈঃস্বরে সারি গান গাইতেন তখন আর অন্য নৌকার খবর থাকত না। আমার বাবার মধুর কণ্ঠ ছিল। কণ্ঠে পাওয়ার ছিল। ওস্তাদের কণ্ঠ ছিল ভাঙা ভাঙা। তিনি গান গাইলে সুর নানা দিকে ছড়িয়ে যেত। তার অর্ধেক কথা মানুষ বুঝতই না। কিন্তু তার তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে বাবা পারতেন না। এই জন্য আমি বলব যে, একেকজন একেক দিকে ভালো করতেন।
মমতাজ : বাবার মৃত্যুর বেশি দিন হয়নি। তিনি ২০০৬ সালে ইন্তেকাল করেছেন।
মমতাজ : আমার ওস্তাদের মতো জ্ঞানী মানুষ খুবই কম ছিল। গাইতেন, লিখতেন নিজের মতো করে। অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন। মঞ্চে উঠে কথা বললে মানুষ অবাক হয়ে শুনত। তিনি যদি কাউকে গালিও দিতেন এরপরও মানুষ মনে করতেন যে এই গালির মধ্যে জ্ঞান আছে। মানুষ খুবই সমীহ করতেন তাকে। তিনি বাইরেও যেমন ছিলেন ভেতরেও তেমন ছিলেন। এরকম একজন ওস্তাদ হারানোর পর যে শূন্যতা দেখা দেয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এখনও মনে হলে স্থির থাকতে পারি না।
মমতাজ : দু’জনই জ্ঞানি ছিলেন। তবে রশিদ সরকার ছিলেন একেবারেই আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। তিনি সব সময় পীর মাশায়েখের জীবনকেই অনুসরণ করতেন। তিনি নিজেও বড় মাপের পীর ছিলেন। তার ভিতরে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে ভরা ছিল। বলতে পারেন, ইহকালের চেয়ে পরকালের ভাবনাই তার কাছে গুরুত্ব পেত।
মমতাজ : রশিদ সরকার মারা গেছেন আমার বাবার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পর। তার মৃত্যুর পাঁচ বছর হয়েছে। আর ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান মারা যান বাবার মৃত্যুর চার পাঁচ বছর আগে। একই দশকে তিন জনই মারা যান। এটি আমার জীবনের জন্য বড় শোকের।
মমতাজ : আমার বাবা সুখ দেখে গেছেন। আমার হাসপাতালগুলো দেখে গেছেন। আমার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তার হাত দিয়েই করা। মহাখালীর এই বাড়িতেও তিনি থেকে গেছেন। ২০০৬ সালে যখন এই বাড়িতে উঠি তখন বাবা খুবই অসুস্থ। বাবার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিল। অ্যাপোলোতে চিকিৎসা করিয়েছি। আমার এই বাড়িতে রেখে তাকে কেমো থেরাপি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি এখানে থাকতে চাইতেন না। তিনি বলতেন, আমাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে চলো। সেখানে বড় একটি ড্রয়িং রুম ছিল। জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত বাবা সেখানে বসেই সকলের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। বাবার প্রিয়জনরা রাতভর কাছে বসে গল্প করেছেন। গান শুনিয়েছেন। বাবা যখন একেবারেই অন্তিম শয্যায় তখন একদিন আমার কাছে গান শুনতে চাইলেন। আমি তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। মনে হলো, সব গান ভুলে গেছি। বাবাকে বললাম, বাবা আমি গান মনে করতে পারছি না। পাথরের মতো বুক ভার হয়ে গেল। তখন বাবা বললেন, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের একটি গান শোনাও।
মমতাজ : ‘সুখ পাখিটি গেছে মারা একটি তীরের আঘাত খাইয়্যারে, আমি আজও কান্দি পাখিটির লাইগ্যারে’ এই গানটি শোনালাম। গানটি মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা। যখন গাইছিলাম তখন আমার কণ্ঠ ধরে আসছিল। আমি গানটি শেষ করতে পারিনি। তখন বাবা বললেন, তুমি নামের অন্তরাটি গাইলে না। গানে ওস্তাদের নাম নেয়া হচ্ছে আদব। যারা গান লেখেন, সুর করেন তাদের নাম শেষ অন্তরায় নিতে হয়। তার মানে বুঝতেই পারছেন গানের প্রতি বাবার কী মনোযোগ ছিল। এটি বাবার মৃত্যুর চার পাঁচ দিন আগের ঘটনা।
মমতাজ : বলতে পারেন এটি একটি স্টাইল। তবে এর একটি উদ্দেশ্যও আছে। শত বছর আগে গানটি কে করেছিল তা তো কোথাও লেখা থাকে না। গানের মধ্যেই গায়কের পরিচয় তুলে ধরা হয়। লালন ফকির, বিজয় সরকাররা তাদের নিজস্ব গানের মধ্যেই বেঁচে আছেন। একইভাবে আমার গানেও মাতাল রজ্জাক দেওয়ান, শাহ আলমরা গুরুত্ব পেয়ে আসছেন। তাদের লেখা গানে তাদের নাম নেয়া আদবের বিষয়।
মমতাজ : আমি প্রতি বছর বাবার নামে মধু মেলার আয়োজন করি। বাবা বেঁচে থাকতেই ২০০০ সালের দিকে এই মেলার আয়োজন করি। আগে মহররম মাসে করতাম। এর পর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মেলা বসে। বাবা ৩১ ডিসেম্বর মারা যান। ওইদিন মিলাদ মাহফিল দিয়ে আমরা মানুষকে খাওয়াই। আর ১, ২, ৩ জানুয়ারি বাউল গানের আসর বসে। সারা দেশ থেকেই বাউল শিল্পীরা আসেন। দেশের বাইরে থেকেও শিল্পীরা আসেন। ভারত থেকে কবিয়ালরা এসে কবিতা পাঠ করেন। মধু মেলার জন্য এলাকার মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। সাপ্তাহিক-এর মাধ্যমে পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। পালা গান নিয়ে এতক্ষণ যা বললাম, মধু মেলায় এলে তা উপভোগ করতে পারবেন।
মমতাজ : কোম্পানিগুলো ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ান বা রশিদ সরকারের ক্যাসেট করতেন। আমি তখন কোনো গুরুত্ব পেতাম না। এ নিয়ে আমার কোনো ভাবনাও ছিল না। জনি ইলেক্ট্রনিক্স একদিন রশিদ সরকারের পালাগান নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। ওইদিন রশিদ সরকার জনি ইলেক্ট্রনিক্সকে বলেন যে, আমার তো অনেক অ্যালবাম করলেন, এবার মমতাজের একটি একক অ্যালবাম করেন। ও ভালো গায়। একটি অ্যালবাম করে দেখতে পারেন। তখন জনির পক্ষ থেকে বলা হয়, নতুন শিল্পী। যদি ক্যাসেট না চলে? এর আগে তো তার কোনো অ্যালবাম করা হয়নি। তখন রশিদ সরকার আবারও অনুরোধ করে বললেন, দেখেন মঞ্চে এখন মানুষ আমাদের চেয়ে ওর গান বেশি পছন্দ করে। সব জায়গাতেই গায়। একটি অ্যালবাম করে দেখেন না ভাই। না চললে পুরো টাকা ফেরত দেয়া হবে।
মমতাজ : হ্যাঁ, প্রথম জনি ইলেক্ট্রনিক্সে গান করতে গেলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই আটটি গান করে ফেললাম। তখন জনি ইলেক্ট্রনিক্সের মালিক এসে একটি গান শুনতে চাইলেন। গান শুনে তিনি আমাকে বললেন, আপনার কাছে কি আরও গান আছে? আমি বললাম, অনেক গান আছে। আমার কাছে তো আর গানের অভাব নেই। আমার ডায়েরি রশিদ সরকার আর ওস্তাদের লেখা আধ্যাত্মিক গানে ভরা। তিনি বললেন, এটি আধ্যাত্মিক করলেন। এবার একটি বিচ্ছেদ অ্যালবাম করেন। এভাবে ফুল শিফটে দুটি অ্যালবাম করি। আধ্যাত্মিক অ্যালবামটি হলো আমাদের অনুরোধে আর বিচ্ছেদ অ্যালবামটি হলো তাদের অনুরোধে।
মমতাজ : আধ্যাত্মিক গান নিয়ে করা অ্যালবামটির নাম ছিল মমতাজের ‘খেলছে পাখি উল্টা কলে’ এবং অপরটি ছিল ‘বিচ্ছেদ সুপার’।
মমতাজ : দ্বিতীয় অ্যালবামটির জন্য দু’হাজার টাকা দেয়া হলো। যেহেতু এটি তাদের অনুরোধে করা হয়। কিন্তু প্রথমটির জন্য কোনো টাকা দেয়া হলো না। বরং ক্যাসেটের কাটতি না হলে খরচের টাকা উল্টো ফেরত দিতে হবে এমন শর্ত ছিল।
মমতাজ : সে তো আরেক অভিজ্ঞতা। ব্যাপক কাটতি হলো। সারাদেশেই ক্যাসেটের দোকানে মানুষের ভিড় পড়ে গেল। আমরা যখন বিভিন্ন জায়গায় পালা গান করতে যেতাম তখন ক্যাসেট সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। দর্শকরা মুহূর্তের মধ্যেই কিনে শেষ করে দিত। আমার জীবনের প্রথম অ্যালবাম নিয়ে জনি ইলেক্ট্রনিক্সও সফল ব্যবসা করল।
মমতাজ : না। আমি বললাম, এটি তো কোনো শর্ত হতে পারে না। আপনার কোম্পানিকে দুটি করে দিয়েছি, আপনি চাইলে আরও অ্যালবাম করে দিব। কিন্তু অন্য কোম্পানির সঙ্গে অ্যালবাম করতে পারব না তা তো হতে পারে না।
মমতাজ : ধীরে ধীরে সঙ্গীতা, মুন প্রোডাক্টস, চেনা সুরের মতো বিখ্যাত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি হতে থাকল। বলতে গেলে, বাংলাদেশের সব সঙ্গীত কোম্পানি থেকেই আমার অ্যালবাম বের হয়েছে।
মমতাজ : গেয়েছি। তাদের সঙ্গে আরও অ্যালবাম বের করেছি। পালা গানের অ্যালবামও করা হয়েছে। তবে এককভাবে কারও সঙ্গে চুক্তি করিনি। এ কারণেই হয়ত প্রচার বেশি হতে থাকে। সারা রাত পালা গান করতাম আর দিনভর এসে রেকর্ডিং করতাম। প্রতিষ্ঠিত সব বাউল শিল্পীর সঙ্গে অ্যালবাম বের হতে থাকল। কোম্পানিগুলোও আমাকে নিয়ে মহাখুশি। রেকর্ডিং করার জন্য সিরিয়াল ধরে থাকত।
মমতাজ : নিশ্চয় পার্থক্য থাকে। সময়ের ব্যবধানে জীবনের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে যায়। আমার বেলাতেও ব্যতিক্রম ছিল না। গানের ধরনও হয়ত বদলে যেতে থাকে। তবে কণ্ঠের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং সুরে আরও ভারত্ব চলে আসে।
মমতাজ : দুটোই ভালো লাগত। দর্শকের ভালো লাগাইতো শিল্পীর ভালো লাগা। যখন পালা গান হতো তখন পালার মধ্যেই মন চলে যেত। আবার যখন বিচ্ছেদ গাইতাম, তখন পালার কথা ভুলে যেতাম। আগে তো মানুষ বিচ্ছেদের জন্য পাগল হয়ে যেত। পালা গানের মাঝে মাঝেই বিচ্ছেদ গাইতে হতো। তখন মানুষ শুধু আনন্দ করতেই গান শুনতে আসত না। মানুষ গানের ভাষায় নিজের ভাষা প্রকাশ করতে চাইত। মানুষ গভীর মনোযোগ দিয়ে গান শুনত। আগে মানুষকে না কাঁদাতে পারলে গান হতো না। আর এখন মানুষকে না নাচাতে পারলে গান হয় না। আসল পার্থক্যটা হচ্ছে এখানেই।
মমতাজ : বিশেষ কিছু পেতে গেলে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারাতে হয়। হয়ত আমিও অনেক কিছুই হারিয়েছি। যে বয়সে মেয়েরা পুতুল খেলত সেই বয়সে রাতের পর রাত গান করেছি। একজন ছেলে মানুষ স্বপ্ন দেখে একজন ভালো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করার। আবার একজন মেয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে ভালো একজন ছেলেকে বিয়ে করার। হয়ত কেউ পড়াশোনা করে বড় চাকরি করার স্বপ্ন দেখে। আমার জীবনে এমন স্বপ্ন দেখার সুযোগ হয়নি। শুধু গানই ছিল আমার স্বপ্ন, গানই ছিল আমার সাধনা। এ কারণে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সুখ, সমৃদ্ধি সব বিসর্জন দিয়েছি। গানে কী করে ভালো করা যায়, এটিই ছিল আমার একমাত্র ভাবনা। আমি দেখেছি, দর্শকরা ওস্তাদদের নানা প্রশ্ন করতেন। সব প্রশ্নের উত্তর যে তারা জানতেন তাও নয়। কিন্তু এমন কৌশলে বুঝিয়ে দিতেন যে, দর্শকের মনে আর কোনো জিজ্ঞাসা থাকত না। এই কৌশলগুলো তো কাছে থেকে দেখেছি। কখন, কোন পরিস্থিতিতে দর্শকরা কী ধরনের আবেদন করতে পারেন সে দক্ষতা শত শত প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার কারণেই আয়ত্ত করতে পেরেছি। দর্শকের মন, পরিবেশ বুঝতে পারা সত্যিই একটি কঠিন কাজ।
মমতাজ : না, আমি কখনও রেওয়াজ করিনি। শুনি, অনেকেই সকাল বিকাল রেওয়াজ করেন। আমার তা প্রয়োজন হয়নি। আমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারি না। হারমোনিয়ামে হাত দিলেই ঘুম আসে। ঝিমানি ভাব ধরে। আমি গান করতাম আর বাবা হারমোনিয়াম বাজাতেন।
মমতাজ : আছে। বেহালা বাজাতে পারতাম। গানে যতটুকু দরকার পড়ত সেইভাবেই বেহালা বাজাতাম। আমার বাবার গুরু মাইনুদ্দিন পীর সাহেব আমার গান শুনে একটি বেহালা উপহার দেন। তার বাড়ি সাভার গোকুলে। এই বেহালা বাজিয়েই গান গাইতাম। কিন্তু হারমোনিয়ামে বসে সা-রে-গা-মা কোনোদিন করা হয়নি।
মমতাজ : যন্ত্র নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয় না। আমার সুরের নিজস্ব ঢং আছে। আমি আমার সেই ঢঙে গান করি। যন্ত্রীরা কী বাজালো বা না বাজালো আমি তা গুরুত্ব দেই না। অনেক বেসুরা যন্ত্রের সঙ্গে নিজের তাল ঠিক রেখে গান করেছি। অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই অপরিচিত যন্ত্রীদের সঙ্গে গান করতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার কোনোদিন এমন হয়নি। আমি গাইব আমার মতো করে। বাদ্যযন্ত্র আমার সঙ্গে আসতে পারলে আসবে না পারলে নাই। আমার সুর তো আমার কানে বাজে। এটাই আমার যন্ত্র।
মমতাজ : জীবনে অনেক মাজারেই গান করেছি। যখন যেখানে গিয়েছি, সেখানেই পীর মাশায়েখের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের উপদেশ, পরামর্শ পেয়েছি। আমিও তাদের ভক্তি শ্রদ্ধা করতাম। তবে ব্যক্তিগতভাবে রশিদ সরকার পীর সাহেবের হাতেই আমি বায়াত গ্রহণ করি। আমার পীরের নাম তুলা চাঁন। তিনি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরের রসুলপুর গ্রামের বরিয়াবর দরবার শরীফের পীর সাহেব ছিলেন। বরিয়াবর দরবার শরীফের নাম বললে সবাই চেনেন। আমার পীর বাবার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই ফকির।
মমতাজ : ২০০২ সাল নাগাদ আমি পালাগান করতাম। প্রায় দেড় দশক পালাগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।
মমতাজ : ২০০২ সালের পর অনেক অ্যালবাম বের হয়ে গেল। অ্যালবামগুলো ব্যাপক হিট গানে ভরা। আবার একক বিচ্ছেদ গাইতাম। এরপর মঞ্চে উঠলে দর্শকরা বিচ্ছেদ বা হিট গানগুলো শুনতে চাইত। সব অনুষ্ঠানেই আর পালাগান করা সম্ভব হলো না। আর আমার নিজের কাছেও মনে হতো যে, আমি মনে হয় একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আছি। মুরব্বিরা যারা বিচ্ছেদ, মুর্শিদী গান পছন্দ করেন কেবল তারাই আমার গানের শ্রোতা। এ যুগের ছেলেমেয়েরা আমার গান শুনছে না। শহরে কোনো বাড়ির ড্রয়িং রুমে আমার গান বাজে না। এই বিষয়গুলো মনে খটকা তৈরি করত। এত চ্যানেলও ছিল না। তখনই ভাবলাম যে, আমি সবার জন্যই গান করব।
মমতাজ : না, টাকা পয়সার চিন্তায় আমি পালাগান ছাড়ি নাই। আমার মনে হয়েছে যে বিশেষ এই গন্ডি থেকে বেরুনো দরকার। রাতভর পালাগান করেছি। তখন কিন্তু কোনো বিদেশের প্রোগ্রাম আসেনি। এখন দেশ, দেশের বাইরে গান করছি। আমি তো সবার জন্য গান করছি।
মমতাজ : আপনার কী মনে হয় যে, আমি তাদের পছন্দের গান ছেড়ে দিয়েছি। আমি তো সবাইকে নিয়েই আছি। মুরব্বিরা কেবল তাদের পছন্দের গানই গাইতে বলেন। আমি যদি ‘খায়রুন লো’ না গাইতাম তাহলে তো আপনি আমাকে চিনতেন না। আমার গান শুনতেন না। আজকে আমি বা আমরা যদি বাংলা গানকে এই জায়গায় না নিয়ে আসতাম তাহলে আপনারা শুনতেন হিন্দি বা ইংলিশ গান। সেটা কী ভালো হতো। যেটাই হোক বাংলাই তো গাচ্ছি। আজকে আমরা এই গানগুলো তুলে এনেছি বলেই হাবিব বা বালামদের গান আপনারা পছন্দ করছেন। আমরা না গাইলে তো এই গানগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে পারতেন না। বিচ্ছেদ নিয়ে গ্রামে পড়ে থাকলে বাংলার মাটির গানগুলো এমনভাবে গুরুত্ব পেত না। আলেয়া, আকলিমা আমার সিনিয়র শিল্পী। তারা এখনও পালা করছেন। কিন্তু নিজের জীবন বা গানে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি। তাতে কী লাভ হলো। আর সত্য কথা বলতে কী, কোনো কিছুই অপূর্ণ থাকে না। আমি আজ পালাগান গাইছি না সত্য, কিন্তু অন্য কেউ হয়ত গাইতেছে। একজনের অভাব তো আরেকজন পূরণ করবেই। এটিই জগতের নিয়ম।
মমতাজ : আমি রিমিক্স বা ফিউশনকে কখনও খারাপভাবে মূল্যায়ন করি না। আজকের ছেলেমেয়েরা বাংলা গানের ফিউশন শুনে মজা করছে। এতে খারাপ কী? বিয়ে বাড়িতে শিল্পী মিলার ‘রুব্বানে নাচে কোমর দুলায়া’ শুনে নাচতেছে। যদি এটি না থাকত তাহলে হিন্দি ‘কাটা লাগা’ শুনে নাচত। তাতে কী ভালো হতো। ‘বাবুজি’ বা ‘কাটা লাগা’র জায়গায় এখন ‘নান্টু ঘটক’ বা ‘রুব্বানে নাচে’ বাজানো হচ্ছে। আমি এটিকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি।
মমতাজ : আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, আমি কিন্তু এখনও পালা করি। আমিই প্রথম চ্যানেলে পালা গানের সংযোজন করেছি।
মমতাজ : ২০০৭ সালে পহেলা বৈশাখে বৈশাখী টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে প্রথম পালাগান গাই। আমার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী শাহ আলম। এরপর বিটিভিতে সুনীল বাবুর সঙ্গে আরও একটি পালা গান করি। তখন অনেক চ্যানেলের পক্ষ থেকেই আমাকে প্রস্তাব করা হলো পালাগান করার জন্য। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেইভাবে আর সময় দেয়া হয়নি। রাজনীতির কারণেই হয়ে উঠছে না। এখন চ্যানেল নাইনে কবির লড়াই নামে পালাগান চলছে। কিন্তু শুরু আমিই করেছি। গত কোরবানির ঈদে বাংলাভিশনে আরিফ দেওয়ানের সঙ্গে পালা করেছি। এবার ঈদুল ফিতরে বড় আবুল সরকারের সঙ্গে পালা গাইছি। দর্শকরা মুগ্ধ।
মমতাজ : পরিবর্তন তো আনতেই হয়। আগের যে যন্ত্র তার সঙ্গে ভারী যন্ত্রও ব্যবহার করতে হয়। দু’ধারার যন্ত্র ব্যবহার করেই গাইতে হচ্ছে।
মমতাজ : দৌড় ছবিতে প্রথম গান করি। রাধা বল্লভ সরকারের লেখা ‘ধান্ধাবাজির ধোঁকায় পড়ে’ গানটি গাই। এটি মুজিব পরদেশীর সুরে করা। এরপর ‘হৃদয়ের বন্ধন’ ছবিতে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও একটি গান করলাম। ওই ছবিতে গানটির সঙ্গে আমি নিজে অভিনয়ও করেছিলাম। আর রথীন্দ্রনাথের জায়গায় অভিনয় করেছিলেন আমির হোসেন বাবু।
মমতাজ : আমি তাদের কাছে যেতে পেরেছি বলেই তো তাদের ‘মমতাজ বুবু’ হতে পেরেছি। আমি এখনও কাছে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। রাস্তায় বের হলে রিকশাওয়ালার পকেটে রাখা মোবাইলে আমার গান শুনতে পাই। বাসা থেকে বের হলে গেটে দারোয়ানের মোবাইলে আমার গান শুনতে পাই। পাশের বাড়ির কাজের বুয়ার কোমরে গুঁজে রাখা মোবাইলে আমার গান বাজে। সন্ধ্যায় যখন হাঁটতে বের হই তখনও শুনি আমার গান। একদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হয়ে দেখি পাশের বাড়ির দারোয়ান চাচা আমার গান বাজাচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, চাচা ভালো আছেন। পরে আমাকে বলছেন, আপনাকে দেখার জন্যই এই বাড়িতে চাকরি নিয়েছি। তিনি বলেন, আপনার গানের ক্যাসেট দিয়ে আমার বাড়ি ভর্তি। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। তখন মনে হয়, এদের কারণেই আমি মমতাজ। সাধারণ মানুষের দোয়া, ভালোবাসা থাকার কারণেই আজকে এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
মমতাজ : অনেক পরে। প্রথম কানাডা থেকে লোক সাহিত্যের ওপর এক মহিলা গবেষক আমার বাড়িতে আসেন। সঙ্গে সাংবাদিকরাও ছিলেন। ওই ভদ্র মহিলা আমার লোকগীতি নিয়ে কাজ করেন। বিষয়টি সংবাদপত্রে লেখালেখি হয়। এরপর অল্প অল্প করে পত্রিকায় নাম আসতে থাকে। এভাবেই মিডিয়াতে পরিচিতি পেতে থাকি।
মমতাজ : ঠিকই বলেছেন। শিল্পী জীবনে মিডিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিডিয়ার সহযোগিতা ছাড়া নিজের অর্জনগুলো ধরে রাখা যায় না। গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে মিডিয়ার প্রয়োজন তো আছেই। আমিও সেইভাবেই দেখছি। অনেক সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে গুরুত্ব দিয়েই কথা বলেছি। ’৯৮ সালের পর পত্রিকাগুলোয় ছবি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হতে থাকল। প্রথম পাতায় শিরোনাম হতে থাকলাম। এরপর ২০০০ সালে ইত্যাদিতে গান করার পর সকল গণমাধ্যমের কাছে গুরুত্ব বেড়ে গেল। অনেকেই কাভারেজ দিতে থাকলেন।
মমতাজ : ইত্যাদির হানিফ সংকেত ইতোমধ্যেই আমার ব্যাপারে জেনে যান। চারিদিকে আমার গান বাজে। ক্যাসেটের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। কিন্তু টেলিভিশনে কোনো গান করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে হানিফ সংকেত ভাই নাকি দীর্ঘদিন ধরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। তখন তো আর এখনকার মতো মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। আমার একটি টেলিফোনের মতো বড় মোবাইল সেট ছিল। কিন্তু ঘরের মধ্যে নেটওয়ার্ক থাকত না। এন্টেনা লাগিয়ে কথা বলতে হতো। আর তখন আমি এত ব্যস্ত যে, পালাগানের প্রোগ্রাম করে শেষ করতে পারছি না। সর্বোচ্চ রেটে গান করছি। রাতেও গান করছি, দিনেও গান করছি। আমাকে সে পাবে কেমনে। বায়না করতে লোকজন গ্রামের বাড়িতে আসত। একপর্যায়ে একদিন মোবাইলে হানিফ সংকেত আমাকে পেয়ে যান।
মমতাজ : আমি তো আর হানিফ সংকেতকে চিনি না। টেলিভিশনও দেখি না। দেখি না মানে সময় পাই না। তিনি বললেন, আমি ইত্যাদির হানিফ সংকেত। আমার কাছে সে নাম প্রথম। অন্যদের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলা তার সঙ্গেও একইভাবে কথা বলছি। তিনি বললেন, তোমাকে নিয়ে ইত্যাদিতে একটি প্রোগ্রাম করতে চাই। আমি বললাম, সিডিউল দেখতে হবে। কারণ, আমি খুবই ব্যস্ত। তখন তিনি বললেন, তুমি জানো আমি কে? আমি চাইলে যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি। তোমাকে যতদিন ধরে খুঁজছি, ততোদিনে যে কোনো জিনিস চাইলেই আমি পাইতাম। আমি তখন বললাম, ভাই আমি সারারাত গান গেয়ে দুপুর দুটো পর্যন্ত ঘুমাই। আবার বিকালে প্রোগ্রামের জন্য রওনা হই। এ কারণেই হয়ত যোগাযোগ হয়নি। তবে আমি গান করব। কুমিল্লায় প্রোগ্রাম করার আগেই আপনার গান করে যাব। তিনি বললেন, একটু সময় নিয়ে আসবেন। আমি বললাম, আমার গান করতে সময় লাগে না। সমস্যা নেই। যখন ডাকবেন তখনই গাইতে পারব।
মমতাজ : হ্যাঁ, বিখ্যাত গীতিকার রফিকুজ্জামানের সুরে গানটি করলাম। বেশ মজা করে গাইলাম। এরপর কুমিল্লা থেকে এসে শুটিংও করে দিলাম। এভাবেই প্রথম টেলিভিশনে আসা। ওই দিন হানিফ সংকেত উপস্থাপনার সময় বললেন, আজ এমন একজন শিল্পী আপনাদের সামনে গান করবেন, টেলিভিশনে তিনি আজ প্রথম এসেছেন। কিন্তু ইতোমধ্যেই তার তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ অ্যালবাম বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
মমতাজ : নিশ্চয় অন্য রকম ছিল। রেল স্টেশনের পাশে শুটিং হলো। আমি একটি দামি শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন তো দামি শাড়ি পরি না। প্রোগ্রামে সুতি সাদা শাড়ি পরতাম। এখানে একটি কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমিই প্রথম পালা গানের মঞ্চে শাড়ি ব্যবহার করি। এখন হয়ত অনেকেই করছেন। কিন্তু শুরুটা আমিই করেছি। আমি ভাবতাম, বাংলার বাউল গান করব আর বাঙালি পোশাক পরব না তা হবে না। আমি সাদা সুতি কাপড় পরে একটি বেহালা হাতে নিয়ে গান শুরু করলেই আসরে অন্যরকম পরিবেশ চলে আসত। সত্যিকার বাউল শিল্পীর বেশ ফুটে উঠত। পনেরো বছর বয়স থেকেই শাড়ি পরে গান করতাম। ইত্যাদির প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গানের শুটিং করলাম। অবশ্য দামি শাড়ি পরে শুটিং করা হয়নি। হানিফ সংকেত ভাইয়ের অনুরোধে আগের সুতী শাড়ি পরেই শুটিং করলাম। এটি ছিল আমার জীবনের বাড়তি অভিজ্ঞতা।
মমতাজ : অনেকেই ভালোভাবে দেখতেন। আবার অনেকেই ভালোভাবে নিতে চাইত না। এমন সংকীর্ণ মানসিকতা তো আমাদের আছে। আমি শাড়ি পরে গান করছি, এটি দেখতে ভালো লাগলেও আমি পরছি বলেই অনেকে তা পরতেন না। আমি তাদের বলতাম, ভাবের গান করেন কিন্তু ভিতর বাহিরে যদি বাউল হতে না পারেন তাহলে সাধনা মিলবে না। আপনার পোশাক পরিচ্ছদে, চলনে, বলনে যদি নিজস্ব স্বকীয়তা তুলে না ধরতে পারেন তাহলে গানে ভাব আসবে না। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যে বয়সে বাউল জগতে গিয়েছিলাম এবং যা পেয়েছিলাম তা যদি ধরে রাখতে পারতাম তাহলে এতদিন হয়ত অন্য একটি জগতের মানুষ হতে পারতাম। এখন সংসার, রাজনীতির কারণে সেই জগতের স্বাদ নিতে পারছি না। কষ্ট হয়। এখন যেখানে আছি সেটাও একটি জগত। কিন্তু ওই জগতে থাকলে শিল্পী মমতাজ অন্যরকম হতে পারত। আজ ঢাকায় থাকার কথা নয়। অন্য জগতে ডুবে থাকার কথা ছিল।
মমতাজ : সঠিক কোনো হিসাব রাখা হয়নি। তবে সাত শতের ওপরে অ্যালবাম করা হয়েছে। গিনেসবুক রেকর্ডের জন্য যখন অ্যালবামগুলো চাওয়া হয়েছিল, তখন পাঁচশর মতো সংগ্রহ করেছিলাম। সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। কারণ আমি ওইভাবে সংগ্রহে রাখিনি। নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করে জমা দিয়েছিলাম। ওগুলো এখন আমার কাছে আছে। অনেকগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে তিন বছর ধরে সব ঠিক করেছি। অডিও ক্যাসেটগুলো সিডিতে রূপান্তর করেছি। আমি যখন মিউজিয়াম করব তখন এগুলো কাজে লাগবে।
মমতাজ : অডিও, ভিডিও, ফিল্ম এবং পালাগান মিলে দশ হাজারের ওপরে গান করা হয়েছে। এখনও তো চলছে।
মমতাজ : আন্তর্জাতিকভাবে আমার পরিশ্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ গিনেসবুকে জায়গা দেয়া। যে কোনো পরিশ্রমের স্বীকৃতিই চরম আনন্দের। আন্তর্জাতিকভাবে এই বিরল স্বীকৃতি পুরো জাতির জন্য সম্মান বয়ে এনেছে বলে আমি মনে করি। দেশের মানুষের পক্ষ থেকেও কোনো সংবর্ধনা, সম্মান জানালে আমি পরম পাওয়া মনে করি। মানুষ আমার অ্যালবাম, গান নিয়ে আলোচনা করে। এখন বিশ্ব দরবারেও আলোচনা হচ্ছে। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
মমতাজ : ইচ্ছে হয়। কারণ ওস্তাদকে মানুষ সত্যিই আলাদভাবে মূল্যায়ন করে। কাউকে নিজের মতো করে গান শেখাব সে ইচ্ছা অনেক আগেই থেকে ছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে পারিনি। আর ইচ্ছা থাকলেই সবার পক্ষে সব জিনিস করা সম্ভব হয় না। আমি হয়ত ভালো গাইতে পারি কিন্তু ভালো নাও শেখাতে পারি। আমার ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাকের কণ্ঠ ভালো ছিল না আগেই বলেছি। কিন্তু তার শেখানোর ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি যেভাবে শিখিয়েছেন সেভাবে আমি শেখাতে পারব বলে মনে হয় না। এছাড়া অনেকেই বলেন, সুর হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত। কারও মধ্যে সুর থাকলে এমনিতেই প্রকাশ পাবে। তা কেবল শেখানোর ওপরেই নির্ভর করে না। যেমন, রশিদ সরকার বলতেন, যে গাছের ডাল দিয়ে লাঙ্গল হবে তা শুরুতেই বাঁকা হয়। আর বাঁকা হলে লাঙ্গল এমনিতেই হয়। সোজা হলে জোড়াতালি ছাড়া কাজ হবে না। গানের বেলাতেও তাই।
মমতাজ : আমি পৈতৃক সম্পত্তির মতো গানের জগৎ পেয়েছি। জন্মের পরেই বাবার হাতে দোতারা, হারমোনিয়াম দেখেছি। আল্লাহ সুর দিয়েছেন আমাকে। ওস্তাদের কাছে গিয়ে সে সুরে আরও ধার এসেছে। আল্লাহ কোরানে বলেছেন, আমি কথা বলার শক্তি সবাইকে দিলেও সুর সবাইকে দেইনি। সুরের শক্তি এবং ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে খুশি তাকে দেন। গান অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু গাইতে পারেন কয় জন। গান গাওয়ার ইচ্ছা তো সবারই হয়।
মমতাজ : আমি ব্যক্তি উদ্যোগে বাউল তথ্য সংগ্রহশালা করার চেষ্টা করছি। আমি সারা দেশে গান করতে গিয়ে দেখেছি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক ভালো ভালো বাউল রয়েছেন। তাদের অনেকেই মারা গেছেন। অনেকে বেঁচে আছেন। যারা মারা গেছেন, তাদের অনেক স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র রয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার যারা বেঁচে আছেন তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ তাদের খবর রাখেন না। আমি নিয়ত করেছি, সারা দেশ থেকে বাউলদের নানা স্মৃতি সংগ্রহ করব। তাদের লেখা গান, বাদ্যযন্ত্র মিউজিয়ামে রেখে দেব। মানুষ যেন তা দেখে চিনতে পারে, জানতে পারে। আমার নিজের অর্জনগুলোও সংগ্রহশালায় রাখব। কারণ নিজে নিজের অর্জনগুলো নিয়ে কাজ করলে আলাদা আনন্দ পাওয়া যায়।
মমতাজ : গ্রামের বাড়িতে করব। সেখানে বেঁচে থাকা অবহেলিত, বঞ্চিত বাউলদেরও একটি জায়গার ব্যবস্থা করব। পরিকল্পনা হয়ে গেছে। এখন শুরু করা। ব্যস্ততায় শুরু করতে পারছি না এই চিন্তায় সারাক্ষণ অস্থির থাকি। গ্রামের বাড়িতে আমি ইতোমধ্যেই একটি জায়গা বরাদ্দ করেছি।
মমতাজ : আমার অর্জন নিয়ে আমি খুশি। আমি তো বলেছি, গান ছাড়া আর কিছু বুঝি না। গানের মধ্যেই জীবনের সব কিছু পেয়ে গেছি। এখন কোনো অভাব বোধ নেই। আমি মনে করি, বাংলা লোকসংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য সামান্য চেষ্টাও যদি করে থাকি সেটাই আমার সার্থকতা। আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দিনকে এখনও মানুষ মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। হয়ত একশ বছর পর আমার গান শুনেও কেউ এরকম স্মরণ করবে। এভাবেই তো মানুষ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকে। আমি মিউজিয়াম করে সেখানে আমার সব কিছু রেখে দিব। দুইশ, তিনশ বছর পর মানুষ আমাকে জানতে পারবে। তারা আমার অর্জনগুলো দেখে উৎসাহিত হবে। লোকসংস্কৃতিতে নিজেকে মেলে ধরবে। হয়ত এর মধ্যে অনেক কিছুরই পরিবর্তন আসবে। এসেছেও বটে। কিন্তু মানুষ তো অতীত থেকে শিখতে চায়। আমি সেই অতীতের কেউ হতে চাই। এটিই তো একজন শিল্পীর প্রত্যাশা।
মমতাজ : ঠিকই বলেছেন। প্রত্যেকেরই কিছু কিছু নিজস্ব ঢং রয়েছে। আমিও হয়ত তার বাইরে নই। অনেকেই অন্যের সুরে গান গায়। কিন্তু আমার সুরের নিজস্বতা রয়েছে। কেউ চাইলেও আমার সুরে গান করতে পারেন না। মানুষ হাজার সুরের মধ্যে আমার সুর বুঝতে পারেন। এটি আমার উত্থানের জন্য বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। একইভাবে আমার গানের ভাষা একবারে মানুষের জীবন ঘেঁষা। প্রেম, প্রীতি, আনন্দ, বেদনা নিয়েই মানুষের জীবন। প্রত্যেকের জীবনেই কিছু পাওয়া কিছু না পাওয়ার বিষয় থাকে। আমার গানের ভাষায় সে বিষয়গুলোই খোলামেলাভাবে ফুটে ওঠে। আমিও হয়ত অন্যকে অনুসরণ করে থাকি। কিন্তু নিজের তো কিছু থাকতে হবে। নিজের কিছু না থাকলে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। আমাকেও অনেকে অনুসরণ করে থাকেন বলে জানতে পাই। অনেকে আমার নামে নাম রেখেও গান করেন। একবার এক অনুষ্ঠানে মমতাজ নামে শিল্পী গান করবেন বলে মাইকিং করা হচ্ছে। মাইকিং শুনে আমার এক ভক্ত ফোন দিয়ে বললেন, আপা আপনি কী অমুক জায়গায় গান করতে আসবেন? আমি বললাম না তো। তখন সে জানালেন, আপনার নাম নিয়ে মাইকিং হচ্ছে তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তখন ভালোই লাগে।
মমতাজ : প্রত্যেকের জীবনেই বিচ্ছেদের কিছু ঘটনা আছে। কেউ বলেন, কেউ বলেন না। এ কারণে বিচ্ছেদ গান সবারই ভালো লাগে। বিচ্ছেদ শুনে মানুষ তার হারানো বেদনার মধ্যে জীবন খুঁজতে চায়। এ কারণে আমিও বিচ্ছেদ গাইতে ভালোবাসি। গানের মধ্যেই আমি প্রেমকে উপলব্ধি করতে থাকি। ‘বুকটা ফাইট্যা যায়’ এ ধরনের গান যখন আমি গাই তখন নিজের মধ্যেই একটি ভাব চলে আসে। সেই ভাব গানে ফুটে ওঠে। তা শুনে মানুষ বেদনার মধ্যেও আনন্দ পায়। অনেকে আবার না বুঝেই আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন। যেমন, এই গানটি মঞ্চে গাইলে তরুণরা আনন্দ উল্লাস করে। আসলে এটি ওই অর্থে আনন্দ, উল্লাসের গান নয়।
মমতাজ : জীবনে প্রেম আসেনি, তা বলা ঠিক হবে না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই প্রেম আসে। কিন্তু আমার জীবনে প্রেম ছিল গৌণ। আমার গানের জগতের সামনে প্রেমের ভাবনা কখনও দাঁড়াতে পারেনি। জীবনে প্রেম যতটুকু উপলব্দি করতে পেরেছি সেটুকু নিয়েই থাকার চেষ্টা করেছি। বাড়তি কিছু ভাবি না। আমার প্রেম গানের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তি জীবনের প্রেমের চেয়ে গানের সঙ্গে প্রেম করেই বেশি আনন্দ পেয়েছি। এ জন্য আমি মনে করি, অন্যের প্রেম আর আমার প্রেমের ধরন আলাদা।
মমতাজ : আমি আমাকে নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করি। আমার স্বামী, সন্তান বা মাকে ভালোবাসার চেয়ে নিজেকে বেশি ভালোবাসি। নিজের সঙ্গেই নিজে প্রতিনিয়ত প্রেম করে যাচ্ছি। আমার এই প্রেম, ভালোবাসার জগৎ থেকে যে যতটুকু নিতে পারে সেটা তার ব্যাপার। যার সঙ্গে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বিনিময় হয়ে থাকে। না পাইলে আপত্তি থাকে না। আমি তো মানুষের মাঝেই আছি।
মমতাজ : আমার গানে দয়াল মূলত মহান আল্লাহ তায়ালাকেই বুঝানো হয়। সৃষ্টিকর্তার রহমতের নজর পড়লেই কেবল আমি মানুষ হিসেবে কিছু পেতে পারি। আমার কোনো ক্ষমতা নেই। দয়াল দয়া করলেই নিজেকে চিনতে পারব। যেমন আমি হচ্ছি একটি ছোট্ট খাল আর দয়াল হচ্ছে মহাসাগর। আমি চাইলে মহাসাগরে যেতে পারব না। কিন্তু মহাসাগর তার জোয়ারের মাধ্যমে আমার কাছে আসতে পারে। এই জন্যই দয়ালের কাছে মিনতি।
মমতাজ : ফকিরি মানুষ নানাভাবেই আয়ত্ত করতে পারে। কেউ ঘরের বাইরে গিয়ে করে আবার কেউ ঘরের ভেতরেই করতে পারে। বিষয়টি হচ্ছে নিজের কাছে। আমি হয়ত ঘরের বাইরে গিয়ে গান করেছি কিন্তু ফকিরি ঘরের মধ্যেই আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি। তবে ফকিরি যেভাবে নিতে হয় সেভাবে পারিনি। সংসার জীবনকে গুরুত্ব দিলে ফকিরি আসে না। আর এখন তো সংসার, রাজনীতি নিয়েই আছি।
মমতাজ : ২০০১ সালে প্রথম লন্ডনে গান করতে যাই। সেখান থেকে এসে অল্প দিনের মধ্যেই আবার অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরে গেলাম। এর পরে তো নিয়মিতই দেশের বাইরে যাওয়া। বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষি মানুষ আছেন সেখানেই গান করতে গিয়েছি।
মমতাজ : দেশের বাইরে গেলেও বাঙালি মন তো রেখে যান না। মন নিয়েই যান। এ কারণে বাংলা গান শুনলেই তারা আনন্দ পেয়ে থাকেন। বরং তারা আরও বেশি করে মজা করেন। এর কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকতে থাকতে মন বিষিয়ে ওঠে। তখন এরকম গান শুনতে পেলে যে কারোই ভালো লাগে। অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে যায়।
মমতাজ : সিনেমা করার সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করেই নেয়া। কোনো পরিকল্পনা ছিল না। হঠাৎ করে একজন পরিচালক প্রস্তাব করেছিলেন এবং বাউল শিল্পী শাহ আলমের অনুরোধেই ছবিটি করা। তবে ছবিটি আমার মনমতো হয়নি। তথাকথিত সিনেমার মতো আমার জীবন নিয়ে সিনেমা হতে পারে না। এখানে অনেকটাই তাই হয়েছে। অনেক কৃত্রিমতা ছিল। আমার তো আর কৃত্রিমতার দরকার পড়ে না। নিজের জীবনেই তো অনেক সিনেমার মতো ঘটনা আছে। সেগুলো তুলে ধরে সিনেমা করলেই অনেক ভালো হতো। নিজেও হয়ত অভিনয় করে তৃপ্তি পেতাম। এরপরেও বলতে গেলে কিছুটা হলেও তো বাড়তি অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অবশ্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
মমতাজ : না। চলচ্চিত্রে আসলে সেই অর্থে অভিনয় করার ইচ্ছা নেই। তবে আমার জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে যদি কেউ ডকুমেন্টারি করতে চায় তাহলে হয়ত আপত্তি থাকবে না। আজকে যেমন আপনাকে সব খোলাখুলিভাবে বললাম, এই রকম বিষয় নিয়ে কেউ কাজ করতে চাইলে অবশ্যই সহযোগিতা করব। আমার শৈশবের ঘটনাগুলো আমার জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার শৈশবকাল জানার জন্য অনেকেই উৎসাহ বোধ করেন। আমাকে মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, জানতে চায় সেইভাবে হলেই ভালো।
মমতাজ : ২০০৩ সালে কোয়ালিটি কনডেন্স মিল্ক-এ প্রথম বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে কাজ করার অফার পাই। এরপর আরও অনেক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে সরকারি বা জনস্বার্থে যেসব বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি সেখান থেকে আমি কোনো অর্থ নেইনি। মানুষকে সচেতন করতে পারছি এটি মনে করেই অনেক তৃপ্তি অনুভব করি।
মমতাজ : না, অন্য কোনো গান করার ইচ্ছা নেই। আমি যে ধরনের গান করি তার মধ্যেই থাকতে চাই।
মমতাজ : আমার বাবা-মা হচ্ছেন সবচেয়ে প্রিয়। বাবা-মায়ের কারণেই এই জায়গায় আসতে পেরেছি। তাদের সঙ্গে আর কাউকে তুলনা করতে পারি না।
মমতাজ : আমার কাছেই থাকেন। বলতে পারেন মা আমার চেয়ে শারীরিকভাবে শক্ত। বাড়ির সকল কাজই তিনি করতে পারেন। যখন এখানে আসেন তখন এ বাড়ির সব কাজ তার তত্ত্বাবধায়নে হয়। গ্রামের বাড়িতে থাকলেও তাই। এলাকায় আমার কোল্ডস্টোরেজ আছে, হাসপাতাল আছে এগুলো মা-ই দেখাশোনা করেন। তিনি যেখানে যান সেখানে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।
মমতাজ : নিয়মিত যাই। আপনার সঙ্গে কথা শেষ করেই গ্রামে যাব। বাড়ি, ব্যবসা, হাসপাতাল, রাজনীতি, গ্রামের মানুষ সব কিছ্রু টানেই চলে যাই। গ্রামের মানুষ নিয়েই তো চলছি।
মমতাজ : আমি যখন পালা গান করি তখন বাবার গায়ে পক্স (জলবসন্ত) ওঠে। পক্সের কারণে বাবার চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি। ওইভাবেই বাবা আমার সঙ্গে গান করেছেন। কারণ, আমার গানের সময় বাবাই হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন। ওই সময় বাবাকে দেখে অনেক কষ্ট পেতাম। আর ভাবতাম, আমার কোনোদিন টাকা হলে গরিব, দুঃখী মানুষের জন্য চক্ষু হাসপাতাল দিতাম। এক সময় আল্লাহ আমার আশা পূরণ করে। বাবা বেঁচে থাকতেই ২০০৪ সালে মানিকগঞ্জ সদরে মমতাজ চক্ষু হাসপাতালের উদ্বোধন করি।
মমতাজ : প্রথমে ২৫ শয্যাবিশিষ্ট ছিল। পরে বাড়িয়ে ৫০ শয্যা করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে গ্রামের বাড়িতে মমতাজ শিশু ও চক্ষু হাসপাতালের উদ্বোধন করা হয়। পাঁচতলা ফাউন্ডেশনের নিচতলা এই হাসপাতালটির জন্য বরাদ্দ করি। দুটো হাসপাতালই মমতাজ ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত হয়।
মমতাজ : মমতাজ চক্ষু হাসপাতালের পরে মমতাজ ফাউন্ডেশন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণের জন্যই ফাউন্ডেশন করা হয়।
মমতাজ : আমাদের এলাকায় প্রচুর সবজি চাষ হয়। বিশেষ করে গাজরের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু কৃষক মূল্য পায় না। অনেক সময় গরু-ছাগলের খাবার হয়। এই অবস্থায় চ্যানেল আইয়ে শাইখ সিরাজ ভাইয়ের একটি প্রতিবেদন বের হয়। কৃষকরা সবাই শাক সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থার দাবি জানায়। তখন সিরাজ ভাই নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু গভর্নর বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ এগিয়ে এলে আমরা সহযোগিতা করব। পরে আমি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গভর্নর আতিউর রহমানকে ফোন করেন। এভাবেই কাজটি হয়ে যায়। এখন কৃষকরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। তাদের সবজি আর গাজীপুর বা মুন্সীগঞ্জে নিয়ে যেতে হচ্ছে না। সময়মতো বিক্রি করে ভালো মূল্য পাচ্ছেন।
মমতাজ : আমি আগেই বলেছি যে, আমার বাবা বাদে বংশের অনেকেই ভালো অবস্থায় ছিলেন। আমার এক দাদা দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এবং আত্মীয়স্বজন আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করতেন। আর রশিদ সরকারও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ’৯৬-এর নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে প্রচুর গান করি। এভাবেই এই দলটির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়। পরে ’৯৫-’৯৬-এর দিকে সিঙ্গাইর থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা নির্বাচিত হই। আর এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমাকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ নির্বাচিত করা হয়। আমি সংস্কৃত বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
মমতাজ : আমি যদি দল এবং মঞ্চের বাইরে গিয়ে মন্তব্য করি তাহলে বলব, অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি বলে ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসি, কিন্তু মানুষকে দেয়া কথা রাখি না। সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কোনো কমিটমেন্ট রাখতে পারি না। আমার কাছে এটিই সব চেয়ে কষ্টের। আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু সে প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে যায়।
মমতাজ : রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার। ব্যক্তি বা দলের আগে মানুষের কথা ভাবা দরকার। এই জন্য তরুণদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি।
মমতাজ : সবকিছু মিলে আমি খুব ভালো আছি। আমার তিনটি সন্তান নিয়ে অনেক সুখে আছি। বাউল মানুষ। ভালো মন্দ নিয়েই আছি। বেশি সুখও ভালো না আবার বেশি দুঃখও ভালো না। দুটোতেই বাউল জীবনের ব্যাঘাত ঘটে।
মমতাজ : ছেলে মেহেদী হাসান। ওর বয়স ২০-এর কাছাকাছি। মেহেদীর রশিদ সরকারের ঘরে জন্ম। বড় মেয়ে রুহানী পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ওর বয়স এগারো বছর। ছোট মেয়ে রোজের বয়স আট বছর। প্রথম শ্রেণীতে পড়ছে। ওরা বিএএফ শাহিন স্কুলে পড়াশোনা করছে। মেয়েদের জন্ম রমজান আলীর ঘরে। সন্তানদের নিয়ে যেন সুখে থাকতে পারি খোদার কাছে সবসময় এই কামনাই করি।