ব্রেকিং নিউজ
Home | আন্তর্জাতিক | রাজনৈতিক অচলায়তন কি ভাঙা যাবে না?

রাজনৈতিক অচলায়তন কি ভাঙা যাবে না?

 

স্টাফ রিপোর্টার, ১০ মার্চ, বিডিটুডে ২৪ডটকম : নারায়ণগঞ্জে মেধাবী কিশোর ত্বকির খুনি কারা?
ওর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ, জাগরণ মঞ্চের একজন সংগঠক। সবার ধারণা, নিরপরাধ এই কিশোরের হত্যাকারীর সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত। এ রকম ধারণা হওয়ার কারণ, ইতিপূর্বে মেধাবী ও মুক্তচিন্তার আরও যেসব তরুণ খুন বা খুনের অপচেষ্টার শিকার হয়েছেন, সেসব ঘটনার পেছনেও এদের ভূমিকা উদ্ঘাটিত হয়েছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র রাজীবকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন, তাঁদের বোঝানো হয়েছে, ওকে হত্যা করা একটি জিহাদি কাজ এবং তাই প্রকৃত মুসলমানের জন্য সওয়াবের কাজ।
আমরা পাকিস্তান আমল থেকে দেখে এসেছি, একশ্রেণীর রাজনীতিক কীভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য সাধারণ মানুষের ইসলামি ভাবাবেগকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে এসেছে। ভাষা আন্দোলনের সময় তারা বলত, বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা, ভাষা আন্দোলন ভারতীয়দের উসকানি ও মদদে পরিচালিত হচ্ছে। একসময় তারা বাংলা সাহিত্য, এমনকি রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠের বিরুদ্ধেও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিল। খ্রিষ্টান, ইহুদি বা নাস্তিকের ইংরেজি ভাষার লেখা নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না, আপত্তি উঠেছিল মাতৃভাষায় রচিত হিন্দু লেখকদের লেখা নিয়ে। পূর্ববাংলার যেকোনো অধিকার আদায়ের সংগ্রামকেই পাকিস্তান সরকার ও তাদের এদেশীয় দোসররা ইসলামবিরোধী ও ভারতীয় কারসাজি হিসেবে আখ্যায়িত করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের এই প্রচারণা ও ভূমিকা সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যোদ্ধাদের ভারতীয় চর এবং মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামবিরোধী চক্রান্ত হিসেবে তারা দেশে-বিদেশে প্রচারণা চালিয়েছিল। সেদিন তারা ইসলাম রক্ষার নামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের হত্যা করেছে। সেদিনের ব্যাপক লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের ঘটনা তো হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় ঘটেছে।
এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা ও অপরাধীদের শাস্তি প্রদান একটি জাতীয় দায়িত্ব। কিন্তু বিএনপির অনীহা বা তাদের ওপর নির্ভরতার কারণে এতকাল এই কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে দাবিটি বরাবর উত্থাপিত হচ্ছিল। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ-আদালতে জামায়াতের নেতা গোলাম আযমের বিচার ও ফাঁসির রায়ও দেওয়া হয়েছিল সেই ১৯৯২ সালে। ২০১৩ সালে এসে তরুণসমাজের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে, এত দিন তারা ভেতরে ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা কেবল বিচারে সন্তুষ্ট নয়, তারা চায় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তিনটি বিষয়ে ভাবাবেগ কাজ করে—বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম। এ দেশে বসবাসকারী সব ধর্মের মানুষই ধর্মভীরু হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি অংশ ধর্মীয় ভাবাবেগকে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে এসেছে। তারা এই অবস্থান থেকেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে এ দেশের সব গণ-আন্দোলনের বিরোধিতা করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা দখলদার পাকিস্তান সরকার ও হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীর ভূমিকায় নামে। এভাবে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সেই সময়কার নেতারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যান। কোনো দেশ তার ইতিহাস, বিশেষত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় ও অর্জনকে তো অস্বীকার করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাসে জামায়াত ও সেই ধারার রাজনীতিকদের বক্তব্য ও ভূমিকা বারবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারা কখনো ভুল স্বীকার করেনি, অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। এতে বোঝা যায়, ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম তাদের কাছে মূল বিষয় নয়। কারণ, প্রকৃত ধার্মিক প্রথমত ধর্মের নামে মানুষ খুন করে না, নিজের দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। এসবই ইসলামের শিক্ষার বিরোধী। দ্বিতীয়ত, প্রকৃত ধার্মিক মানুষ ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। বরং ভুল নিয়ে জেদ করা বা ভুল অস্বীকার করে মিথ্যাচারকে পাপ বলেই মনে করবে। তাদের ভুল উপলব্ধি না-করা বা স্বীকার না-করার একটি বড় কারণ হলো, দেশের বড় একটি দল বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে তাদের সমর্থন ও মদদ দিচ্ছে।
কিন্তু আজকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে তরুণসমাজ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিল, তারা কোনো দলের সমর্থনে তা করেনি। আমরা দেখছি, তারা এখনো বিএনপির সমর্থন চাইছে। তাদের ডাকে সারা দেশে নারী-পুরুষ আবালবৃদ্ধবনিতার যে জাগরণ ঘটেছে, তা-ও দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। একাত্তরের পরে এবারই আবার গণমানুষের মধ্যে ঐক্য ও গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা আরও জোরদার হতো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে আবার গড়ে তোলার কাজ সহজ হতো, যদি বিএনপি এ আন্দোলনে শরিক হতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গোড়ার দিকে এ রকম ভাবনা কারও কারও মধ্যে থাকলেও খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিএনপি ইতিহাসের এই ডাকে সাড়া দিল না, ক্ষুদ্র দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না। তারা সম্ভবত ভোটের রাজনীতি এবং তাদের গতানুগতিক আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতির হিসাব কষেই এই পথটি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এ দেশের গণমানুষ তো আকস্মিকভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ধাপে ধাপে নিজের দেশ নির্মাণে এগিয়েছে। সেই বায়ান্ন থেকে এ যাত্রা চলছে। বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি বারবার বাধা দিয়েছে, তাতে সাময়িক বিঘ্ন ঘটেছে, হয়তো লক্ষ্য অর্জন বিলম্বিত হয়েছে। কিন্তু জনগণের অগ্রযাত্রা কখনো বন্ধ করা যায়নি। বরং বাংলাদেশের এই অভিযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে গিয়ে তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।
আজকে তারা গণজাগরণকে নস্যাৎ করতে গিয়ে মসজিদ ও শহীদ মিনারের অবমাননা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তরুণ ছেলেদের মগজ ধোলাই করে মানুষ হত্যার মতো হীন অপরাধে প্ররোচিত করছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো, সম্পদ লুণ্ঠন, তরুণ অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের হত্যা করছে। রাস্তার দুই পাশের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কেটেছে, ২০০ কোটি টাকার পল্লী বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করেছে। সর্বোপরি নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছে।
ইতিহাস সব সময় প্রথা ধরে চলে না। আইন-নিয়ম ও প্রথার গণ্ডিতে তার অগ্রযাত্রা সব সময় বাঁধা থাকে না। প্রচলিত পথে বন্ধ্যত্ব, অচলাবস্থা বা অবক্ষয় দেখা দিলে অতিষ্ঠ, বিক্ষুব্ধ জনগণ পথে নেমে এসে ইতিহাসের বাঁক ফেরান, ভাঙাগড়ার কাজ করেন, নতুনভাবে নির্মাণে হাত দেন। এভাবেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। যেদিন প্রতিপক্ষ জনতার জাগরণকে গ্রাহ্য করেনি, হত্যা ও ধ্বংসের পথে সমাধান করতে চেয়েছে, সেদিন রাজপথ থেকে রণাঙ্গনে যেতে হয়েছে আমাদের। আমাদের প্রথাগত রাজনীতি বহুকাল ধরেই অসহিষ্ণুতা, মৌরসিপাট্টা আর দুর্নীতি-ভোগদখলের নৈরাজ্যে একপ্রকার অচল হয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালে জনগণ রাজপথে নেমে এসে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রাপথ মুক্ত করেছিল। সেদিনও ইতিহাস রাজপথেই নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তী তিন দশকে মানুষ অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছিল। রাজনীতি অবক্ষয়ের অচলতায়ন গতানুগতিক বৃত্তে বাঁধা পড়েছে। এমন সময় শাহবাগের ডাকে তারা নতুন স্পন্দন খুঁজে পেল। ব্যক্তিগত জীবন আর সুবিধাবাদে ব্যস্ত বলে যে নতুন প্রজন্মকে নাগরিক সমাজের মানুষ ততটা হিসাবে রাখেনি, তারা হঠাৎ জানান দিল তাদের দেশপ্রেম, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা কত গভীর। এর মধ্যে মানুষ নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখতে পেয়েছে। তাই দ্রুত এ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। নব্বইয়ের পরে আবার মানুষ জেগে উঠেছে, আশাবাদী হয়েছে, স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তাদের ভরসা কিন্তু রাজনীতিবিদেরা নন, এই নির্দলীয় রাজনীতিসচেতন তরুণসমাজই।
এই আন্দোলন সফল হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে একটি বিভাজন রেখা হিসেবে ধরা যাবে। এর আগেকার রাজনীতি—একদিকে ধর্মভিত্তিক বা পাকিস্তানবাদের রাজনীতি আর অন্যদিকে এক নেতা বা নেত্রীভিত্তিক সামন্তবাদী জগদ্দল সংগঠন নিয়ে রাজনীতি—বাতিল হয়ে যাবে। আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা সহজ হবে।
আবারও বলব, ইতিহাসের এই অভিপ্রায় যা তরুণ প্রজন্মের জাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা বিএনপি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে সহজেই বাস্তবে রূপ নিতে পারবে। নয়তো দেশ সংঘাতের দিকে যাবে। আজ হয়তো নানা কথা বলে বিএনপি তাদের ভুল পথের পক্ষে সাফাই গাইবে, কিন্তু ইতিহাস যেমন নির্মম তেমনি নিরপেক্ষ। এটি তাদের গণবিরোধী ভূমিকা, প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান এবং ইতিহাসের বিপরীতে চলার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমার মনে হয়।
দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বাতাবরণ তৈরি করতে হলে কেবল ধর্মান্ধতা ও পাকিস্তানবাদী রাজনীতির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তা নয়, বড় দুই দলের গতানুগতিক ধারার রাজনীতির অচলায়তনও ভাঙতে হবে। আমার ধারণা, এযাত্রা সফল হলে এই গণজাগরণ থেকেই সেই অতিপ্রয়োজনীয় কাজটিরও সূচনা হতো।

 

x

Check Also

‘গ্রেটার সিলেট এসোসিয়েশন ইন স্পেন’ নির্বাচনে মুজাক্কির – সেলিম প্যানেল বিজয়ী

জিয়াউল হক জুমন, স্পেন প্রতিনিধিঃ সিলেট বিভাগের চারটি জেলা নিয়ে গঠিত গ্রেটার ...

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে পর্তুগাল আওয়ামী লীগের মতবিনিময় সভা

আনোয়ার এইচ খান ফাহিম ইউরোপীয় ব্যুরো প্রধান, পর্তুগালঃ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার ...