রাজনীতি হলো অসম্ভবকে সম্ভব করার এক আধুনিক বিজ্ঞান। রাজনীতিতে আজ যা অসম্ভব বলে মনে হয়, আগামী দিন তা সম্ভব হয়ে উঠে। এটা সবাই জানে যে দেশে দু’বড় দলের রাজনীতি এখন বাইরের দিক থেকে তাকালে সাংঘর্ষিক মনে হয়। কিন্তু সেটা কতক্ষন স্থায়ী হবে?
দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা একটা আতঙ্কের মধ্যে আছে বাংলাদেশকে নিয়ে। তারা মনে করছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মত বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীর উত্থান ঘটার মতো অবজেকটিভ প্রস্তুতি আছে। বিশেষ করে ৯০ এর দশক থেকে রাজনৈতিক শাসনের দুর্বলতার ফাঁকে এটা গজিয়ে উঠেছে।
এখানে ইসলামী অনুশীলন হয় প্রধানত চারটি স্রোত ধারায়। প্রথম ধারায় আছে দেওবন্দী লাইন। তারপর পর্যায়ক্রমে আছে মওদুদীবাদী, আজমীরি ও আলীগড় ধারাসহ অনেক উপধারা।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে ইসলামী জঙ্গীবাদী যারা তাদের অধিকাংশেরই শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়-একটি বিশেষ ঘরানার মধ্যে। আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশ, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ব্যাপক ও দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় তাদের প্রধান আস্তানা এবং এরা বেশিরভাগই হলো পশতুন ভাষী।
এসব অঞ্চলে এখনো অনেক ধর্মান্ধ উপ-গোষ্ঠী আছে যারা টেলিভিশন দেখেনা ও খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়েনা প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার ভয়ে। বাংলাদেশেও সে মতবাদের প্রভাব প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। ভয়টা সেখানেই। তবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে সামরিক জঙ্গীবাদী রাজনীতি গড়ে তোলে টিকে থাকা অসম্ভব ব্যাপার।
এটাতো সবারই বোধগম্য যে সম্প্রতি কেন মায়ানমার ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক একটা গোষ্ঠীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? তারা কেন ভারত মহাসাগর, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে গালফ অঞ্চল থেকে নৌ-বাহিনী সরিয়ে এনে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে? ওরা চীনকে অবরুদ্ধ করতে চায়। সে জন্য এ স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে রাজনৈতিক গোলযোগ বেশী দিন থাকতে পারে না কিংবা থাকতে দেয়া হবে না।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক শূণ্যতার সুযোগে অতীতে সেখানে জঙ্গীবাদ বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশে সে ধরণের কোন পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় এদিকে সংশ্লিষ্ট সবাই তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে। কেন ফখরুদ্দীনরা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দিয়ে সরে দাঁড়াল? কারো কারো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস কেন নিমিষেই থেকে গেল? রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে ইসলামী রাজনৈতিক জঙ্গীদের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মত বাংলাদেশে চাষাবাদ যেন না হয়, সে দিককে প্রধান বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল।
গত জাতীয় নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির গনভিত্তি যে কত দুর্বল ছিল, তা স্পষ্ট বুঝা গেল। সেটা কি আইএসআই আগে জানতো না? নেওয়াজ শরীফ যে ক্ষমতায় আসবে আইএসআই এটা ভালো করেই জানতো।
পারভেজ মোশারফ এক সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে সামরিক বাহিনীর সাথে নেওয়াজের সম্পর্ক কখনো সুখকর ছিল না। তারপরও সামরিক বাহিনীকে সাপের ছুঁচো গেলার মতো তা হজম করতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম অঞ্চল। সুতরাং কারো রাজনৈতিক খামখেয়ালী আচরণ বা নাক উঁচু ভাব খুব সাময়িক ব্যাপার হয়ে থাকবে মাত্র।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানদের ক্ষমতা থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিলো এবং ওসামা বিন লাদেনকে তাদের কাছে ফেরৎ আনার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা করলো, তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। প্রথম দিকে পারভেজ মোশারফ মুসলমানদের রমজান মাসে এ আক্রমনে রাজী ছিল না। তাকে তখন বলা হলো, আফগানিস্তান আক্রমনে যদি পাকিস্তান তার বিমান বন্দর ব্যবহার করতে না দেয়, তবে পাকিস্তানকে পাথরের যুগে ফিরিয়ে নেয়া হবে। আর যায় কোথায় পারভেজ মোশারফ? তারপরের ঘটনাতো সর্বজনবিদিত।
একদিকে বাংলাদেশ একক বৃহৎ শক্তির স্ট্র্যাটেজিকেল সীমারেখায় অবস্থিত, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জরীপে দেখা যায়, এখানে ইসলামী জঙ্গীদের ক্ষেত্র দিন দিন উর্বর হয়ে উঠছে। এটা হচ্ছে দুর্বল গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার ফলে। দু’বড় দলের এ অদূরদর্শিতার ফলে বিরোধী দল সে ১৯৯১ সাল থেকে লাগাতার জাতীয় সংসদে অনুপস্থিত থেকেছে। এভাবে তাদের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মত ইসলামী জঙ্গীবাদকে ঠেকানো কঠিন হয়ে উঠবে।
জঙ্গীবাদ বিকশিত হওয়ার স্পেস সৃষ্টি হবে। সে জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ অবধারিত হয়ে উঠেছে। সে নির্বাচনে চোরের মা আসুক, আর না হয় মহাচোরেরা ক্ষমতায় আসুক- সেটা অপ্রধান দিক হয়ে আছে। প্রধান দিক হলো, জঙ্গীবাদকে শিকড় গজানোর জন্য আর কোন সুযোগ দেয়া যায় না।
যারা মায়ানমারে বাঘে ও মোষে এক ঘাটে পানি যাওয়াতে পারে কোন স্লেজ হ্যামার ব্যবহার না করে, তাদের পক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান ঋণাত্মক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। অতএব সব দল যাতে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে- সে পরিবেশ সৃষ্টি করা সবারই কাম্য। আমাদের বিশ্বাস, অচিরেই রাজনীতিতে সব গুমোট অবস্থা কেটে যাবে এবং অসম নির্বাচনী মাঠ সবার জন্য সমান হয়ে উঠবে।