স্টাফ রিপোর্টার : মরেও শান্তি পাবেন না’ কথাটা হরহামেশাই শোনা যায়। এটা বদদোয়া কিংবা কথার কথা যা-ই হোক না কেন, ঢাকা শহরে সরকারি বড় দুটি গোরস্থানে আদপে তা-ই হচ্ছে। মানুষের ইহজীবন শেষের এই শেষ ঠিকানা নিয়ে ব্যবসায় মেতেছে একদল গোরখোদক।
সরকারি গোরস্থানে স্থান সংকটের কারণে নিয়মিত বিরতিতে পুরোনো কবর মাটিতে মিশিয়ে সদ্যমৃতদের কবর দেয়ার জায়গা করে দেয় নগর কর্তৃপক্ষ। তাই কারো কবর সংরক্ষণের সুযোগ থাকার কথা নয় সেখানে। কিন্তু মাস চুক্তিতে নিয়মিত ভাড়া দিয়ে গেলে কবর টিকিয়ে রাখা যায় মেয়াদের পরও। তাই পরিবারের মৃত মানুষটির শেষ স্মৃতিচিহ্ন টিকিয়ে রাখতে মাসিক চুক্তিতে কবরের ভাড়া দেন অনেকে।
সরকারি গোরস্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আজিমপুর কবরস্থান। ৩০ একরের বেশি জমি নিয়ে ১৮০৭ সালের দিকে এর গোড়াপত্তন হয়। রাজধানীতে মানুষের আনাগোনা এবং বসতি যখন ঘন থেকে ঘন হচ্ছিল তখন এত বড় জমিতেও হচ্ছিলো না সাড়ে তিন হাত মাটির সংস্থান। গড়ে ৩৫-৪০ টি কবর প্রয়োজন পড়ে প্রতিদিন। আর বছরে লাগে প্রায় ১৩ হাজার কবর। তাই পুরোনো কবর ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে নতুন কবর দেবার জায়গা করে দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলে কবর ‘চালা’ দেয়া।
নগর কর্তৃপক্ষের নিয়মানুসারে দুই বা তিন বছর পর পর কবর চালা দেয়ার কথা থাকলেও কখনো কখনো তার আগেই এ কার্যক্রম চালানো হয়। আর তাই চাইলেও এর বেশি সময় কবর থাকার কথা নয়। কিন্তু গোরখোদকদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখলে এবং তাদের নিয়মিত বখশিশ (!) দিয়ে খুশি রাখলে কবর টিকে থাকে অনেক দিন ধরে।
জায়গার সংকট যে সব ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা না সেটা বোঝা যায় রায়েরবাজার গোরস্থানে গেলে। আজিমপুর কবরস্থানের চেয়েও কয়েক গুণ বড় জায়গা নিয়ে রাজধানী ঢাকার রায়েরবাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে নুতন এ গোরস্তানটি। গত বছরের মার্চ মাসে সরকারের পক্ষ থেকে কবর দেয়ার জন্য গোরস্তানটি উন্মুক্ত করা হয়। অন্যান্য গোরস্থানে জায়গা সংকট থাকলেও এ ধরনের জটিলতা নেই এখানে।
প্রায় ৮১.৩০৩০ একর জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে রায়েরবাজার গোরস্থান। ১৬টি ব্লকে বিভক্ত গোরস্থানটিতে কবর দেয়া যাবে প্রায় ৯০ হাজার ৫৩৯টি। গত দেড় বছরের বেশি সময়ে রায়েরবাজার গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে আড়াই হাজারের মতো। পুরাতন কবর তুলে নতুন কবর দেয়ার মতন অবস্থা তৈরি হয়নি এখানে। তারপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে এখানে।
মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, তাদের কাছ থেকে কবর দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩০০ টাকা করে প্রতি মাসে দাবী করছেন গোরখোদকরা। না হলে কবর ভেঙে নতুন কবর দেয়া হবে এমন হুমকিও দিয়েছেন কয়েকজনকে। বাধ্য হয়ে কবর সংরক্ষণের ভাড়া গুনছেন অনেকে। এ অনিয়ম এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে রায়েরবাজার গোরস্থানে। বিষয়টি নিয়ে ভোগান্তিতে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা।
মোসা. মাহিনুর আট মাস আগে তার মায়ের দাফন করিয়েছেন এই গোরস্থানে। বিবাহিতা হওয়ায় স্বামীর বাড়ি টঙ্গীতে থাকা হয় তার। পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই, তাই মাঝে মাঝে মায়ের কবর দেখতে অত দূর থেকে ছুটে আসতে হয় তাকে।
আলাপকালে মাহিনুর বলেন, “আমি তো নিয়মিত আসতে পারি না। করবস্থানে মেয়েদের আসা ঠিক না, জানি। কিন্তু আমার পরিবারে কোনো ছেলে নাই যে এসে দেখে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই আসতে হয়। কিন্তু প্রায়ই এসে দেখি কবরের উপর ঘাস গজিয়ে একেবারে জঙ্গল হয়ে গেছে। গোরখোদকদের টাকা দিলে তবেই পরিষ্কার করে। নিয়মিত মাসে ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। আমি তো শশুরবাড়ি থাকি, প্রতি মাসে কি আর আসা সম্ভব? এরা পরিষ্কার করে রাখলেই পারে। কিছুদিন পর পর আসলেও আমি ওনাদের মাসিক পাওনা তো দিয়েই দিই।’
একই অভিযোগ পাওয়া গেছে গোরস্থানে আসা আরো অনেকের কাছ থেকে। প্রায় প্রত্যেকেই মাস চুক্তিতে টাকা দেন গোরখোদকদের। তাদের ভাষ্যমতে, ৩০০ টাকা খুব বড় অংক না হলেও পুরো ব্যাপারটার ভেতরে একধরনের অমানবিকতা রয়েছে।
সবার জন্য না হলেও কারো কারো জন্য এই ৩০০ টাকাই অনেক বড় অঙ্ক। ১৪ বছরের মো. সোলায়মান সে কথাই বলল। সোলায়মানের বাবা ভিক্ষা করতেন। কিছুদিন আগে তিনি মারা গেছেন। মাকে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে রীতিমতো কষ্ট হয় তার। এতটা নাজুক অবস্থায় থেকে মাসে ৩০০ টাকা বাবার কবরের পেছনে দেয়াটা নিদারুণ গায়ে লাগার মতন।
সোলায়মান বলে, ‘আব্বায় মইরা গেছে, হে তো বাইচ্চা গেছে। সমেস্যায় পড়ছি আমরা। মায় বাসা বাড়িতে কাম করে। ঘর ভাড়া দেওয়া লাগে। টাহাই তো থাহে না। কবরের জন্য টাকা দিমু কি দিয়া?’
এ নিয়ে কথা বলতে গেলে গোরখোদকরা বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করলেন না। তবে মাসিক ভাড়া নেয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয় বলেই তাদের দাবি।
গোরখোদক মো. শাহাজাহান বলেন, ‘আমরা তো পারমেট (স্থায়ী) চাকরি করি না। কন্টাকটারের কাম করি। কবর দিলে যে যা খুশি হইয়া দেয় সেইডাই আমরা পাই। কেউ না দিলে নাই। এইডা তো আর জোর করার জায়গা না।’
তাদের আয়ের ব্যাপারে শাহজাহান বলেন, ‘দিনে যে কয়টা কবর হয়, সেখান থেকে যে কয় টাকা আসে সবাই সমান ভাগ কইরা নেই। দিনশেষে দেহা যায় ২০০ টাকাও জনপ্রতি কেউ ভাগে পায় না। বাঁশ চাটাইয়ের টাকা নেয় কন্টাকটার। ঐডা আমরা পাই না। আর মাসিক বেতনের ব্যাপারডা আমরা কাউরে জোর করি না। কেউ কেউ তিনশোর বেশিও দেয়।’
গোরখোদক মো. সিদ্দিকও তার সহকর্মী শাহাজাহানের সাথে সুর মেলান। তিনি বলেন, ‘আমরা তো সরকারি কাম করি না। যে যা দিয়া যায় এইডা দিয়াই আমরা চলি। কেউ ৩০০ দেয় কেউ আরো বেশিও দিয়া যায়। তার বদলে দুই বেলা কবরে পানি দেই। ঘাট-টাস পরিষ্কার করি। এই কামগুলা যে করি আমগোও তো একটা বেতন থাকা উচিত।’
এ বিষয় জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি রায়েরবাজার গোরস্থানের দায়িত্বে থাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা মো. আব্দুল আজিজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে মোট পাঁচজন সরকারি কর্মচারী আছে। গোরখোদকরা কেউ সরকারি লোক না। অন্য কোনো গোরস্থানেও সরকারি লোক নাই। টেন্ডার দেয়া হয়। টেন্ডার যে পায় সেই কাজ করে। ঠিকাদারি সিস্টেমেই কবর দেয়ার কাজকর্ম পরিচালিত হয়। এভাবেই চলে আসছে। বাকিটা সিটি কর্পোরেশন ভালো বলতে পারবে।’