স্টাফ রিপোর্টার : দেশের মানব পাচার প্রতিরোধের পুরোটায় বলতে গেলে এখনো বেসরকারি সংস্থা অর্থাৎ এনজিও নির্ভর। বিশেষ করে পাচারের সাথে জড়িত অপরাধীদের শাস্তি এবং পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনে সরকারি পর্যায়ে তেমন কিছুই হয়না বললেই চলে। সরকারি পর্যায়ে গঠিত জেলা মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি শুধুমাত্র পাচার বিরোধী কিছু মোটিভেশনাল ওয়ার্ক করে থাকে। দেশের ২৫টি মানব পাচার প্রবণ জেলার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার সার্বিক পরিস্থিতি এমনই।
জাতিসসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউএনডিপি ও ইউনিসেফের তথ্যমতে গত তিন দশকে বাংলাদেশে থেকে প্রায় দশ লাখ মানুষ পাচার হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে।
সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা কক্সবাজার আলোচিত ছিলো সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ায় মানুষ পাচারের জন্য। ২০১২ থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রথমে কক্সবাজার পরে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে হাজার হাজার মানুষ বোটে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান করা আড়াই লাখ বাংলাদেশির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গেছে সমুদ্র পথে।
আইনশৃংখলা বাহিনীর সাড়াঁশি অভিযানে সমুদ্র পথে মানব পাচার বন্ধ হলেও এই পাচারের শিকার অনেকেই এখনো নিখোঁজ। নিখোঁজদের অনেকেই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের কারাগারে আটক থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে অনেকেরই সমুদ্র সলিল সমাধি হয়েছে অথবা দালালদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে মালয়েশিয়ার সীমান্তের কাছে থাইল্যান্ডে ৬০টি গণকবর পাওয়া গেছে। গণকবরগুলোতে পাচারের শিকার বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদেরকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো।
পাচারের শিকার অনেকেই নিখোঁজ
মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি নামের সরকারের একটি সংগঠন জেলা পর্যায়ে কাজ করলেও কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম এলাকায় ঠিক কি পরিমান মানুষ নিখোঁজ আছে তার কোন হিসাব নেই। যেসব দালালরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে হাজার হাজার মানুষ পাচার করেছে তাদের অনেকেই থেকে গেছে ধরা ছোয়ার বাইরে। আবার পাচারের শিকার অনেকে দেশে ফিরে আসলেও তারা সঠিকভাবে পূনর্বাসিত হচ্ছেনা।
কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার রশিদ আহমদের ছেলে জহুর আলম সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বাড়ী থেকে বের হয় ২০১৩ সালে। এরজন্য স্থানীয় বদি আলম নামের এক ব্যক্তিকে ২০হাজার টাকা দেয়া হয়। দীর্ঘদিনেও ছেলের খোঁজ না পেয়ে রশিদ আহমদ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অনেকের কাছে গেছেন, শেষ পর্যন্ত থানায়ও গেছেন কিন্তু বদি আলমের বিরুদ্ধে কোন আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
রশিদ আহমদ বলেন, “প্রথম প্রথম দালাল বদি আলম আমার ছেলেকে খুঁজে দিবে বলে মেম্বার চেয়ারম্যানের কাছে অঙ্গীকার করেছিলো, কিন্তু এখন সে পলাতক, এলাকায় আসেনা।”
কক্সবাজার জেলায় মানব পাচার আইনে ২০১২ সাল থেকে এই পর্যন্ত দায়ের হওয়া ৪৩৭টি মামলা বিচারাধীন থাকলেও বিচারক সংকটের কারণে কোন মামলারই বিচার কাজ এগুচ্ছেনা। মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ না হওয়ায় নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকই এই দায়িত্ব পালন করছেন।
কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটার নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিচারক না থাকায় মানব পাচারের এসব মামলার শুনানীও হচ্ছেনা, তাছাড়া তদন্তে দুর্বলতার কারণে অনেক মামলা প্রমান কঠিন হয়ে পড়বে।
মানব পাচার প্রতিরোধের জন্য ২০১২সালে সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে আইন প্রনয়ন করা হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধের বিচার অভিযোগপত্র প্রদানের ১৮০দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার বিধান আছে। তবে, কোন কারণে বিচার সম্পন্ন করতে সামর্থ্য না হলে ট্রাইব্যুনালকে তার কারণ ব্যাখ্যা করে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রতিবেদন প্রেরণ করতে হবে। কক্সবাজারে ২০১২সাল থেকে এই পর্যন্ত ৩৭টি মামলা সামাজিকভাবে মীমাংসা হয়েছে।
পুনর্বাসনের জন্য এনজিও নির্ভরতা
কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনস দ্বীপের ২০ বছরের যুবক মোরশেদ আলম, ২০১৩ সালের দিকে স্থানীয় একটি মাদ্রসায় পড়তো। এক সন্ধ্যায় দালালরা তাকে বোটে তুলে দেয় মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য। এর কয়দিন পরে মোরশেদের পরিবারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেয়া হয়। মালয়েশিয়ায় কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে কয়েক মাসের মধ্যে সে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইওএমের সহায়তায় দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরলেও পরিবারের সামর্থ্য না থাকায় দালালদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বর্তমানে সে মানব পাচার নিয়ে কাজ করে এই রকম একটি বেসরকারি সংস্থার তত্ববধানে আছে। এই সংস্থায় মোরশেদকে পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে একটি ছোট খাট চাকরিও দেয়া হয়েছে।
মোরশেদ জানায়, “আইওএম সহায়তা না করলে হয়তো এতদিনও মালয়েশিয়ার জেলে থাকতে হতো, দেশে ফিরে এনজিও ‘ইপসা’য় চাকরি করছি, সুযোগ পেলে আবারো পড়া লেখা শুরু করবো।”
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় পাচারের শিকার ব্যাক্তিদের জন্য একটি সেপ হোম আছে কক্সবাজার জেলায়। যেখানে গত পাচ বছরে পাচারের শিকার প্রায় তিন হাজার নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়া হয়েছে।
সেপ হোমটির ম্যানেজার জিসু বড়ুযা জানিয়েছেন, “পাচারের শিকার ব্যক্তিরা উদ্ধার হলেও কিংবা অন্য কোন সেবার প্রয়োজন হলে পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়, পাচারের শিকার অনেককে প্রথমে পরিবার গ্রহণ করেনা, তখন তাদেরকে এখানে থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত ইউএসএইড এর সহায়তায় বাংলাদেশ কাউন্টার ট্রাফিকিং ইন পার্সন (বিসি/টিআইপি) প্রোগ্রামের অধীনে এই সেপ হোম পরিচালিত হয়, উল্লেখ করেন তিনি।
কক্সবাজার মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্য এডিসি জেনারেল সাইফুল ইসলাম বলেছেন, মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালানো হয়, যার ফলে সমুদ্র পথে মানব পাচার অনেক কমে গেছে।
পাচারের শিকার ব্যক্তিদের জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ওরিয়েনেটশানসহ অনান্য কর্মসূচী নেয়া হয়, বেসরকারি সংস্থাগুলো যেমন কাজ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করে, উল্লেখ করেন তিনি।
বর্তমানে মানব পাচার প্রতিরোধে তিন বছর মেয়াদি তৃতীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৫-১৭ হাতে নেয়া হয়। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা, উদ্ধার, প্রত্যাবাসন, পুনর্বাসন, আশ্রয় নিবাস প্রতিষ্ঠা, ক্ষতিপূরণ দেয়া, গোপনীয়তা এবং মর্যাদা রক্ষা করাসহ পুনরায় পাচার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের- ২০১২ এর ৩২ থেকে ৪০ ধারায়।
গত জুনে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মানব পাচার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ‘টায়ার-২’ থেকে এক ধাপ নেমে ‘টায়ার-২ ওয়াচ লিস্ট’ বা দ্বিতীয় স্তরের নজরদারিতে থাকা দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সরকার পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেয়নি। ওই ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুসারে পুনর্বাসনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।