স্টাফ রিপোর্টার : নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তার একটি বাস্তবায়ন করতে গেলেই কমিশনের চার হাজার কোটি টাকার মতো লাগতে পারে। অথচ নির্বাচনের জন্য এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ২৯২ কোটি টাকা। আর এই ব্যয়ের হিসাব না করেই বিএনপি নেতারা তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।
১৫ অক্টোবর রবিবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপে বসে। এ সময় দলের পক্ষ থেকে ২০টি প্রস্তাব দেয়া হয় কমিশনকে। যার একটিতে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ক্লোজ সার্কিট বা সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
দশম সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ১৮ হাজার ২০৮টি আর ভোটকক্ষ ৯১ হাজার ২১৩টি। আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র কতগুলো হবে সেটি এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। তবে ভোটার সংখ্যা বাড়লে বাড়তে পারে কেন্দ্রও এবং সেটি এক লাখে পৌঁছার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এই প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন একটি বিরাট কর্মযজ্ঞের বিষয়। পাশাপাশি এতে লাগবে বিপুল অংকের টাকা। বিএনপি তাদের প্রস্তাবে প্রতিটি ভোটকক্ষে একটি না একাধিক ক্যামেরা লাগাতে হবে, সেটি বলেনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সড়কগুলোতে পাঁচ হাজার সিসি ক্যামেরা ও ৪০ হাজার নতুন এলইডি বাতি ও সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার সরবরাহ ও স্থাপন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। ওই প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪২ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
পাঁচ হাজার সিসি ক্যামেরা, সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার সরবরাহ ও স্থাপনে যদি ওই টাকার অর্ধেক ২২১ কোটি টাকাও ধরা হয় তাহলে সারাদেশে এক লাখ সিসি ক্যামেরা বসাতে খরচ পড়বে চার হাজার কোটি টাকা। অথচ গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির মোট বাজেট ছিল ২৯২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিসিটিভি বসানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করবে সেটি ইসির বিষয়।’
আপনাদের এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে কত টাকা লাগতে পারে, সে হিসাব কি করেছেন- জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘কত টাকা লাগবে সেটি আমরা হিসাব করব কেন? আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। এটি গ্রহণ করবে কি করবে না সেটি ইসির বিষয়। আর গ্রহণ করলে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে কত টাকা লাগবে সেটি ইসিই দেখবে। সেখানে টাকার হিসাব আমাদের করার দরকার নেই। আমরা সেটি করিও নাই।’
তবে সরকারি এই প্রকল্পের মতো উন্নত মানের ক্যামেরার বদলে যদি সাধারণ মানের ক্যামেরা বসানো হয়, তাহলে খরচ কিছুটা কমবে। তারপরও একটি ক্যামেরা বসানো থেকে শুরু করে সার্বিক প্রক্রিয়া শেষ করতে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকার প্রয়োজন হবে। সে হিসেবে সারাদেশে এক লাখ ভোটকেন্দ্রে একটি করে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হলে তাতে খরচ পড়বে ২০০ কোটি টাকা। এর বাইরে আছে ফুটেজ সংরক্ষণ, তার জন্য ডিভাইস কেনা, কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। এতেও খরচ পড়বে আরও বিপুল অংকের টাকা।
রাজধানীর পুরানা পল্টনের ইসলাম এস্টেট মাকের্টের সিসিটিভি ব্যবসায়ী মোবারক জানান, আমরা পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সিসিটিভি বিক্রি করে থাকি। যদি একটি মধ্যমানের সিসিটিভি ক্যামেরা বিক্রি হয় সেটি বসানো আরও অন্যান্য খরচসহ ২০ হাজার টাকা তো লাগবেই।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘বিএনপির এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন আমাদের পক্ষে কঠিন। তবে এ বিষয়ে কমিশন এখনো কোনো ঘোষণা দিতে চায় না।’
নির্বাচনের ব্যয় কত
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে। তখন নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০০ কোটি টাকা। তবে দেড় শতাধিক আসনে ভোট না হওয়ায় অত টাকা ব্যয় হয়নি। সব মিলিয়ে খরচ হয় ২৯২ কোটি টাকা। এর আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খরচ হয় ১৬৫ কোটি টাকা। আর এর আগের অর্থাৎ ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাজেট ছিল ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
বিএনপির অন্যান্য প্রস্তাব
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করতে অন্যান্য যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কার্যকর সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি, এখন থেকেই রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশসহ সব স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার নিশ্চিতকরণ, প্রশাসন দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ, ইভিএম/ডিভিএম যন্ত্র ব্যবহার না করা, ২০০৮ সালের আগের নির্বাচনী সীমানা পুনর্বহাল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, প্রবাসী নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়া, আরপিও সংশোধন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে থেকে নতুন সরকারের দায়িত্বগ্রহণ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতাসহ প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন ইত্যাদি।
বিএনপির এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সংলাপের উদ্যোগ, রাজনৈতিক কর্মীদের মামলা প্রত্যাহার, সভা-সমাবেশ নিশ্চিতকরণ, প্রশাসন দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মতো বিষয়গুলোতে নির্বাচন কমিশনের কিছু করণীয় নেই বলে এর আগে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।