বাগেরহাট প্রতিনিধি : কাস্টমসের হয়রানিমূলক কর্মকা-, খামখেয়ালীপনা ও অনিয়মের কারণে মোংলা বন্দর দিয়ে কন্টেইনার পণ্য আমদানি পূর্বের কয়েক বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। কাস্টমসের হয়রানির শিকার হয়ে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ছেড়ে এখন চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
হয়রানি বন্ধে মোংলা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার এনামুল হক ও উপ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলমকে এখান থেকে সরিয়ে অনত্র্য বদলির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে একের পর এক অভিযোগ জানিয়ে আসছেন বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারকসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা। এই দুই কর্মকর্তার মধ্যে একজনের সম্প্রতি বদলি অর্ডার হলেও তিনি বদলি ঠেকিয়ে এখানেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে বন্দর ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
কাস্টমসের এ অনিয়মের বিষয়ে মোংলা বন্দর উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করার প্রেক্ষিতে মন্ত্রী কাস্টমসকে ব্যবসায়ী সুলভ (ব্যবসায়ীদের সন্তুষ্ট রেখে সেবা দান) সেবা প্রদানের নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছেন। তারপরও কাস্টমস কর্মকর্তারা তাদের খামখেয়ালীপনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারকদের।
কাস্টমসের এই অনিয়মের ফলে গত কয়েক বছর ধরে মোংলা বন্দর দিয়ে কন্টেইনার পণ্য আমদানি মারাত্মভাবে কমতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে যেখানে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টিউস কন্টেইনার পণ্য আমদানি হলেও এর বিপরীতে মোংলা বন্দরে এখন কন্টেইনার আমদানি হচ্ছে মাত্র কয়েক হাজার টিউস। মোংলা বন্দরে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৩ হাজার ৭টিউস, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪২ হাজার ১৩৭ টিউস, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৯৫৩ টিউস, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ হাজার ৯৫২ টিউস ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র ৭ হাজার ৪৮৯ টিউস কন্টেনার পণ্য আমদানি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে কন্টেইনার পণ্য আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাস্টমসের অনিয়ম-হয়রানিকেই দায়ি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাসিস্ট্র, বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স এবং খুলনা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত বিশেষ করে কন্টেইনার পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে মোংলা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার এনামুল হক ও উপ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এক একটি কন্টেইনারের মালামাল সম্পূর্ণ ইয়ার্ডে বের করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আবারো যখন সেগুলো গুছিয়ে কন্টেইনার বোঝাই করা হয় তখন আবারো পরীক্ষার নামে নানা অজুহাতে একাধিকবার পণ্যগুলো বের করে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে আসছেন। চট্টগ্রাম বন্দরে যেখানে নিয়ম অনুযায়ী ১০ শতাংশ পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় আর মোংলা বন্দরের শতভাগ পণ্য দফায় দফায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে হয়রানি, সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। এছাড়া কাস্টমস বার বার কন্টেইনার থেকে পণ্য বের করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত খরচও বেড়ে যায়। ফলে এর প্রভাব পড়ে সর্বক্ষেত্রে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বার্ল্ক পণ্য আমদানিতে সামান্য এদিক ওদিক, কম বেশি হতে পারে। এক্ষেত্রে মোট পণ্য ৫% কম বেশি হওয়ার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি আছে। এই কম-বেশি পণ্য আমদানি হলে চট্টগ্রাম বন্দরে অতিরিক্ত পণ্যের ওপর প্রায় ১০ থেকে ২০% জরিমানা দিয়ে পণ্য খালাসের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে মোংলা শুল্ক কর্তৃপক্ষ ১০০ থেকে ২০০% পুরা পণ্যের ওপর জরিমানা আদায় করে থাকে। এমনকি আইনের সর্বোচ্চ যে পরিমাণ জরিমানা করার বিধান রয়েছে তার চেয়েও কয়েকশ’ গুণ বেশি জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ছেড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন ভেইক্যালস ইম্পোটার্স অ্যান্ড ডিলাররস অ্যাসোসিয়েশন বারবিডার সাধারণ সম্পাদক মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আহবানে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানির মাধ্যমে মৃতপ্রায় বন্দরটিকে আমরা সচল করেছি। আমদানিকৃত প্রায় ৭০ ভাগ গাড়িই এখন এ বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে। কিন্তু আমদানিকৃত গাড়ি কাস্টমস অকশন দেওয়ায় আমদানিকারকরা হয়রানির শিকারসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা কাস্টমসের এই অকশন প্রথা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া জাহাজ থেকে গাড়িগুলো যখন বন্দরের জেটিতে নামছে তখন থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ গাড়িগুলো বুঝে নেওয়ার ফাঁকে মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে এটা আমাদের কাছে চরম উদ্বেগের বিষয়। তিনি আরো বলেন, কাস্টমসের যারা অনিয়ম করে থাকেন তারা নিচু স্তরের কর্মকর্তা। তবে বর্তমান কাস্টমস কমিশনার মারগুব আহমেদ আসার পর থেকে আমরা তার কাছ হতে চাহিদানুযায়ী সহযোগিতা পাচ্ছি।
মোংলা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার এনামুল হক বলেন, আমদানি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন আছে। সেই নিয়ম-নীতি ও রাজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী মোংলা বন্দরের আমদানি পণ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রাজস্ব আদায় করে থাকি। ঘোষণা বহির্ভূত ও অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করলে নির্দিষ্ট জরিমানা আদায় করা হয়। হয়রানি ও অনিয়মের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ব্যবসায়ীরা কখনও আমার কাছে কিংবা কমিশনার মহোদয়ের কাছেও কেউ করেনি। সেহেতু এ অভিযোগ আদৌ সত্য নয়। তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছে যে হিসাব আছে তাতে কন্টেইনার পণ্য আমদানি মোটেও কমেনি। বরং পণ্য আমদানি ও রাজস্ব আদায় পরিমাণ পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিকই রয়েছে। টার্গেট অনুযায়ীই রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া বদলির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাকে বদলি করে আবার এখানেই রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ চাইলে কিংবা বদলি করলে আমি এখান থেকে চলে যাব।
উপ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ঘোষণা বহির্ভূত ও অতিরিক্ত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের প্রতি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অধিক নজরদারী বৃদ্ধি করায় অসৎ ব্যবসায়ীরা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়েই কেউ কেউ পণ্য আমদানি থেকে হয়তো বিরত রয়েছেন। এ কারণেও কন্টেইনার পণ্য আমদানি কিছুটা কমে থাকতে পারে। তিনি আরো বলেন, নিয়মের বাইরে কাস্টমসের কোন হয়রানি ও অনিয়ম করার সুযোগ নেই। যে সকল ব্যবসায়ী অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছেন না তারাই কাস্টমসের বিরুদ্ধে মূলত মিথ্যাচার করছেন।
মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মারগুব আহমেদ বলেন, যুগ্ম কমিশনার এনামুল হক ও উপ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলমকে জড়িয়ে কিছু কথাবার্তা শুনছি। তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে এবং আপাতত কাজকর্ম না দিয়ে চাপের মুখে রাখা হয়েছে। যুগ্ম কমিশনারের বদলির বিষয়ে তিনি বলেন, বদলি আদেশ হলেও তার পরিবর্তে অন্য লোক এখানে যোগদান না করায় কাজের স্বার্থে আপাতত তাকে ছাড়া যাচ্ছে না।
