স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে ব্যবসায়ীর ছেলে বখতিয়ার মোহাম্মদ লতিফ ডাকাতের হাতে খুন হয়েছেন, নাকি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, এর রহস্য উদঘাটনে একাধিক কারণ খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
বখতিয়ারের বাবা জাহিদ আল লতিফ খোকার পারিবারিক, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত এবং বখতিয়ারের প্রেমঘটিতসহ সম্ভাব্য সব ধরনের মোটিভ নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।
এদিকে যাত্রাবাড়ির ৯৬ নম্বর বাড়িটিতে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র সন্তান বখতিয়ারকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা। শনিবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুত্রশোকে বিলাপ আর আর্তনাদ করছিলেন বাবা জাহিদ লতিফ। পাশের কক্ষে একইভাবে ছেলে বখতিয়ারের নাম ধরে শোকে প্রলাপ বলছিলেন মা শামসুন্নাহার ফেরদৌসী, শোকে ভেঙ্গে পড়েছেন স্বজনরাও। বখতিয়ারের বাবা-মাকে কোনো সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না আত্মীয়স্বজন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শুধু ডাকাতিকে প্রাধান্য না দিয়ে সম্ভাব্য সব মোটিভ নিয়েই তদন্তে নেমেছেন তারা। ঘটনার ১৫ দিন আগে ওই বাসার একটি পোষা বিদেশি কুকুরকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলার ঘটনাটি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যোগসাজশ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে উত্তর যাত্রাবাড়ির ৯৬ নম্বর বাড়িতে খুন হন ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার্থী বখতিয়ার মোহাম্মদ লতিফ। আল-সাজেদা ফিলিং স্টেশনের মালিক, পরিবহন ব্যবসায়ী এবং টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের সাংবাদিক শারমিন রিনভীর বড় ভাই জাহিদ আল লতিফ খোকার ছেলে বখতিয়ারকে গুলি করে হত্যা করে স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করে দুর্বৃত্তরা। তবে লুণ্ঠিত মালামালের পরিমাণ খুবই কম বলে জানিয়েছেন নিহতের পরিবার।
এ ঘটনায় বখতিয়ারের বাবা জাহিদ আল লতিফ বাদী হয়ে শুক্রবার রাতে যাত্রাবাড়ি থানায় একটি ডাকাতি ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত ৭-৮ জনকে আসামি করা হয়। এতে আরো উল্লেখ করা হয় দুর্বৃত্তরা ৪ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১ লাখ ৬ হাজার টাকা নিয়ে যায়।
পরিবারের দাবি, দুর্বৃত্তরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে আসলে বাসা থেকে আরো স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু দুর্বৃত্তরা তা না করে বখতিয়ারকে গুলি করার পর বাসায় থাকা তার বাবা-মা ও অন্যান্য লোকজনের হাত বেঁধে রেখে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে। যাতে কেউ গুলিবিদ্ধ বখতিয়ারের কাছে যেতে না পারে।
দুর্বৃত্তরা আধঘণ্টা ধরে বাসায় আলমারির মালামাল তছনছ করার পর চলে যায়। ততক্ষণে বখতিয়ার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে।
এদিকে ঘটনার পর থেকে বখতিয়ারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটটিও পাওয়া যাচ্ছে না। এসব আলামতে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তদের মূল লক্ষ্য ছিল বখতিয়ারকে হত্যা করা।
তবে হত্যাকাণ্ডের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না পরিবারের লোকজন। বখতিয়ারের ফুফু শারমিন রিনভী বলেন, ঘটনাটি পরিকল্পিত হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। আবার কারণও খুঁজে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, তাদের তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে সবাই স্বচ্ছল। তাদের মধ্যে কখনই পৈত্রিক সম্পত্তি বা কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ হয়নি। ভাই জাহিদ লতিফ একজন পরিবহন ব্যবসায়ী। পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তার কারো সঙ্গে ব্যবসায়িক শত্রুতা নেই। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধও নেই।
নিহতের বাবা জাহিদ আল লতিফ খোকা জানান, সম্পত্তি বা ব্যবসা নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই তাদের। এ ধরনের কোনো বিরোধ থাকলে প্রথমে তো তাকেই টার্গেট করা হত।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ এখন পর্যন্ত জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এমনকি এটা খুন না ডাকাতি তাও নিশ্চিত হতে পারেনি। শুক্রবার যাত্রাবাড়ি থানার ওসি রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এটা ডাকাতি নয়, পূর্বশত্রুতার জের।
শুক্রবার আটক বাসার এক গৃহপরিচারিকা চম্পার স্বামী রাসেলকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। রাসেল মৌচাকের সাদ হোটেলের বাবুর্চী।
ঘটনার প্রায় ১৫ দিন আগে বাড়ির পালিত বিদেশি শিকারী কুকরকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলে কে বা কারা। কুকুরটি লোহার খাঁচার মধ্যে থাকলেও পাহারাদারের মত ছিল। তার ভয়ে কেউ বাড়িতে ঢোকার সাহস পেত না। এ কারণে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, খুনের ঘটনাটি পরিকল্পিত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারি কমিশনার মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি ডাকাতি না খুন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বখতিয়ারের বাবা জাহিদ আল লতিফ খোকার পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও সম্পত্তি সংক্রান্ত এবং বখতিয়ারের প্রেম ঘটিতসহ সম্ভাব্য সব ধরনের মোটিভ নিয়ে তদন্ত চলছে। এছাড়া তিনি রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় না থাকলেও এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, মামলাটি শনিবার ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবুও ঘটনা তদন্তে ও খুনীদের গ্রেফতারে ডিবি, সিআইডি ও পুলিশের একাধিক দল সম্মিলিতভাবে কাজ করছে।
তিনি আরো জানান, আটক বাড়ির এক গৃহকর্মীর স্বামী রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তার কাছ থেকে। রাসেল ঘটনার দিন রাতে ওই বাড়িতে তার স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি ওই বাসায় থাকতেন। দুর্বৃত্তরা রাতে বাসায় ঢোকার পরে প্রথমে রাসেলের কক্ষে গিয়ে তাকে বেঁধে ফেলে।