জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া,সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এখন যেন মৃত্যুর মিছিলে পরিনত হচ্ছে। আজ বুধবার সকালে শাল্লা উপজেলার কালিয়াকুটা হাওরে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন আলমগীর হোসেন (৩২),তিনি উপজেলার কাশীপুর গ্রামের ইসহাক মিয়ার ছেলে। এছাড়াও প্রতিদিনেই জেলার তাহিরপুর,জামালগঞ্জ,ধর্মপাশা,বিশ্বম্ভরপুর,দিরাই,শাল্লা,জগন্নাথপুর,ছাতক,দোয়ারাবাজারসহ ১১টি উপজেলার কোথাও না কোথাও বজ্রপাতের আগাতে মারা যাচ্ছে। গত ২মাসের ব্যবধানে ১৮জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৫জনের বেশী।
এদিকে গত দুই বছর অকাল বন্যায় ৯০শতাংশ এক ফসলী বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শোক কিছুটা এবার লাগব হয়েছে ভাল ফসল হওয়ায়। কিন্তু হাওরপাড়ের বাদ সেধেছে কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত। ফলে সারাক্ষনেই প্রিয়জন হারানোর আতœংক বিরাজ করছে জেলার সর্বস্তরের জনসাধারন মাঝে।
শুধু সুনামগঞ্জ জেলাই নয় হবিগঞ্জ,মৌলভী বাজার,নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে একেই অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানাযায়। বজ্রপাত,ঝড়-বৃষ্টির কারনে রৌদ না থাকায় ধান কাটা,মাড়াই ও শুকানোর কাজ করতে পারছে না কৃষকগন। হাওরে প্রকৃতির এই বিরুপ নির্মমতায় পাকা ধান নিয়ে দিশেহারা কৃষক। কিন্তু বজ্রপাত প্রতিরোধক যন্ত্র স্থাপনের দাবী ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন সর্বস্থরের জনসাধারনের মাঝে।
জানাযায়,কালবৈশাখী ঝড় ও সাথে বজ্রপাত এবার যেন মরার উপর খারার ঘাঁ হয়ে সামনে এসে দাড়ায়েছে হাওরবাসীর। এই ভাল এই মন্দ। ক্ষনিকের মধ্যেই রুপ বদলায়। কোন সময় নেই। কখনো কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নীল আকাশ আবার প্রচন্ড বৌদের অতিষ্ট কর তুলছে পরিবেশ। বিদ্যুৎতের লোডশেডিংয়ে ব্যাপসা গরমে অতিষ্ট হাওরবাসী। রাত নামলেই নিজের ও পরিবারের জীবন রক্ষায় ঝড়ের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাত্রি যাপন করছে নিজ বাড়িতেই। এরই মধ্যে হাওরে বোরো ধান কাটছে কৃষকগন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোধমে ঝড় ও বজ্রপাত মধ্যেই।
জানাযায়,বজ্রপাতে গত ২মাসের ব্যবধানের ১৮জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৫জনের বেশী। নিহতরা হলেন,গত ১০মার্চ দক্ষিন সুনামগঞ্জ উপজেলার কাচিঁরভাঙ্গা হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে মোহাম্মদ জালু মিয়া (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের ডিগারকান্দি গ্রামের মৃত মনাফ আলীর ছেলে। ১১এপ্রিল দক্ষিন সুনামগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের ডিগারকান্দি গ্রামের মৃত মনাফ আলীর ছেলে মোহাম্মদ জালু মিয়া (৪৫) ও জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আদরিছ মিয়ার ছেলে সুহেল মিয়া (২৩)। ২৯এপ্রিল সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের লিটন মিয়া (২৮)নামে কৃষক নিহত হয়েছে। তিনি সৈয়দপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার ছেলে। ৩০এপ্রিল সোমবার দক্ষিন সুনামগঞ্জ উপজেলায় মোহাম্মদ ইয়াহিয়া(৩৫)। তিনি কানাইঘাট উপজেলার বড়চতল ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর ছেলে। ১লা মে-সদর উপজেলার মোল্লারপাড়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের রশিদ মিয়া (৪৫)। জামালগঞ্জ উপজেলা কমলা কান্ত তালুকদার (৫৫)। তিনি জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের খোজারগাঁও গ্রামের মৃত কৃষ্ণধন তালুকদারের ছেলে। একেই উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের কলকতা গ্রামের মুক্তার আলীর ছেলে হিরণ মিয়া (৩০),বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের মৃত সাইদুর রহমানের ছেলে আলম মিয়া (৫০)। ০৪এপ্রিল শুক্রবার সকালে মোহাম্মদ জাফর মিয়া(৩৬) নামে এক জন বজ্রঘাতে মারা যায়। তিনি উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের গড়কাটি গ্রামের মৃত লাল মামুদ আলীর ছেলে। ৫মে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের গৌরারং (ইসলামগঞ্জ) ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী একা রানী দাশ (১৮)। তিনি গৌরারং ইউনিয়নের সাফেলা গ্রামের রাদিকা দাশের মেয়ে। ও একই গ্রামের মৃত আব্দুল খালিকের ছেলে এখলাছুর রহমান (৫০)। শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরে ৭মে সকালে বজ্রপাতে নবকুমার দাস (৬৫) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছে। তিনি উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা এসআই নগেদ্র দাসের পিতা। ৮মে একেই দিনে তাহিরপুর উপজেলায় সদর ইউনিয়নের ভাটি তাহিরপুর গ্রামের মুক্তুল হোসেনের ছেলে কৃষক নূর হোসেন (২২),বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় দক্ষিন বাদাঘাট ইউনিয়নের পুরানগাঁও গ্রামের হযরত আলীর স্ত্রী শাহানা বানু(৩৫),একেই উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ক্ষিরদরপুর গ্রামের সুরমা বেগম(২২),দোয়রা বাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ডুববন্ধ গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে ফেরদৌস (১২),দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নেরটংগর গ্রামের মৃত ফজর আলীর ছেলে মুসলিম উদ্দিন(৭৫)।
বজ্রপাতে আহতরা হলেন,জামালগঞ্জের সৈকত তালুকদার (১৫),তার সহোদর পিংকু তালুকদার (২৫) ও একই গ্রামের জ্ঞান তালুকদার (৪৫)। তাহিরপুর উপজেলায় শনির হাওরে পাশ্বভর্তি ইউনিয়ন বাদাঘাট থেকে ধান কাটতে আসা শ্রমিক লিয়াকত মিয়াসহ ১৪জন।
কাল বৈশাখী ঝড় শহরের ইট কাঠের ঘড় গুলোতে আঘাত করে কোন ক্ষতি না করতে পারলেও হাওর পাড়ের বসবাসকারী অসহায় জনসাধরনের টিনেরঘর,গাছ-পালা,মাটি ও ছনের তৈরী ঘর গুলোকে শিলা বৃষ্টি ও কাল বৈশাখী ঝড়ের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এপর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাড়ি-ঘর ক্ষতি,অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে।
পিযুস পুরকাস্থ টিটু সহ জেলার হাওর পাড়ের কৃষক ফেরদৌস আলম,সাদেক আলী,সবুজ মিয়াসহ হাওর পাড়ের বিভিন্ন দ্বীপ সাদৃশ্য গ্রামের কৃষক পরিবারের সদস্যরা বলেন,এবার জেলার প্রতিটি হাওরেই বোরো ধানের ফলন ভাল হয়েছে। তবে আবহাওয়ার বৈরী আচরনে আমাদের আবারও চিন্তার মধ্যে আছি। বজ্রপাত ও বৃষ্টি হলেই আতœংকের মধ্যে থাকি। পাহাড়ী ঢলে বাঁধ ভাঙ্গার ভয়ে। আর বজ্রপাতের ভয়ে শ্রমিকরা ধান কাটতে হাওরে যেতে চায় না মৃত্যুর ভয়ে। হাওরের কৃষকের জীবন বাচাঁতে বজ্রপাত প্রতিরোধক যন্ত্র স্থাপনের পাশা পাশি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবার দাবী করেন হাওরবাসীর।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান,প্রকৃতির বৈরী আচরন হাওর পাড়ে কৃষকগন নিজেদের মত করে পরিবারে লোকজন নিয়েই পাকা বোরো ধান কেটে শেষ করার চেষ্টা করছে। বজ্রপাত তারা সব সময় দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। বজ্রপাত প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।