সৈয়দা নাসরিন ইসলাম : ধর্ষণ এখন একটি অতি পরিচিত শব্দ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধষিতা হচ্ছে আমার বোনেরা। যে পরিমাণে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে তার তিন ভাগের একভাগও প্রকাশ পায় বলে আমার মনে হয় না।
কারণ, এক. আক্রান্ত মেয়েটি জীবনের বাকী সময় সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য মুখ খুলতে নারাজ। দুই. প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সামর্থ নেই তার। তিন. সমাজের প্রভাবশালীদের অনেকেই ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত। সে কারণে ধর্ষণের শিকার হওয়া বোনটি বিচার চাইতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনার কারণে নিরব থাকার চেষ্টা করে আক্রান্ত নারী।
আমরা নারীদের অধিকার চাই। বাংলাদেশে নারী অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সংগঠন মাঠে রয়েছে। নারীরা বিভিন্ন সময় তাদের অধিকার রক্ষার জন্য রাজপথ উত্তালও করেছে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় মানববন্ধন করে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতাও করছে। কিন্তু নারীর প্রতি নির্যাতন কমছে না। এখনো প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারী উত্যক্ত হচ্ছে। লোকাল বাসে যাত্রী হয়ে উঠলে বাসের হেল্পার-এর কাছ থেকে অসৈজন্যমূলক আচরণ পাচ্ছে। চলাচলের রাস্তা থেকে নারীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। ধর্ষণের পর বস্ত্রহীন অবস্থায় লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কখনো ধর্ষণের পর লাশ খুঁজে না পাওয়ার নজিরও রয়েছে আমাদের দেশে। অবশ্য আধুনিক সম্ভ্যতার দেশ ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে ধর্ষণের পরিমাণ হয়তো কিছুটা কম।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে ওই দেশে না কি প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এতো বড় শক্তিশালী নারী সংগঠনগুলো মাঠে সক্রিয় থাকার পরও কেন নারীর প্রতি নির্যাতন ও ধর্ষণ কমছে না?
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নারীদেরকে নিয়ে কী ভাবছে? কোন পথে ধাবিত করা হচ্ছে নারীকে? যাদের মধ্যে ধর্ম-কর্ম ছিল না এক সময় তারাই নারী নির্যাতন করতো। কিন্তু আশারাম বাপুরা যখন নারীকে যৌন হয়রানীর দায়ে গ্রেফতার হচ্ছেন তখন আমরা কাকে দোষারূপ করবো? সম্প্রতিকালে ভারতে নারীকে যৌন হয়রানীর দায়ে একাধিক ধর্মগুরুকে গ্রেফতার হতে দেখা গেছে। আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্যা ‘পরিমল’ যাদেরকে হয়তো আমরা এখনো চিনতে পারি না। ২০১০ সালের শুরুর দিকে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শেষের পাতায় লীড সংবাদ ছিল “লজ্জায় ইডেন ছাড়ছেন ছাত্রীরা” ওই সময় বিভিন্ন সংবাদ পত্রগুলো ইডেন কলেজের নেত্রীদের নারী কেলেঙ্কারী নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করেছিল। ওইসব রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা জানতে পেরেছি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও না কী নারী আসক্তি ভুলতে পারেনি কেউ কেউ। তাহলে আমার বোনেরা কোথায় নিরাপদ?
অতি সম্প্রতি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের কোরাইশমুন্সীতে মা-মেয়েকে গণধর্ষণ করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ওই ধর্ষণের ঘটনায় মেয়েটি এখনো নিখোঁজ রয়েছে। ধর্ষণকারী একজনকে আসামী না করে সাক্ষী করা হয়েছে।
দাগনভূঁইয়ার লতিফপুর গ্রামের মৃত সাহাব উদ্দিনের স্ত্রী-কন্যা কোরাইশমুন্সী বাজারের শাড়ী দোকান ও রোজ বিউটি পার্লার-এর ব্যবসা করতো। তারা ওই এলাকার প্রভাবশালীদের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি এ ঘটনার বিচার পাবে কী-না জানিনা। তবে একথা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে প্রকৃত আসামীদের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা।
১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেলাম ভারতে আবারো ১৯ বছর বয়সী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ছাত্রীকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে মোবাইলে ওইসব ঘৃন্য দৃশ্য ধারণ করে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছে। ওই ছাত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধাও নিয়েছে হিংস্র্র যুবক।
প্রতিবেশী ওই দেশটিতে এবার ধর্ষণে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ধর্র্ষকরা। ২০১৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে এক হাজার ১২১টি। ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৪৬৮টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ২০১১ সালে ৫৭২টি এবং ২০১০ সালে ৫০৭টি মামলা করা হয়।
২০০৯ সালে ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৪৬৯টি। যেখানে ২০০৮ সালে ছিল ৪৬৬টি। ২০০৭, ২০০৬, ২০০৫, ২০০৪, ২০০৩, ২০০২ এবং ২০০১ সালে ধর্ষণ মামলা সংখ্যা ছিল পর্যায়ক্রমে ৫৯৮, ৬২৩, ৫৫৮, ৫৫১, ৪৯০, ৪০৩, ৩৮১টি।
দিল্লী শহরে ছাত্রী জ্যোতি সিংহ পান্ডে যখন গণধর্ষণের শিকার হয়ে নিহত হয় তখন এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার কথা নয়। কারণ, এদেশের এক শ্রেনীর মানুষ ভারতের অনুকরণ করতে অভ্যস্ত। সেক্স স্ক্যান্ডালের যেসব ঘটনা অপ্রকাশিত থাকে তা যদি প্রকাশ পায় তাহলে আমরা আরো বেশি বিব্রত হতাম।
ধর্ষণের ঘটনায় আঁতকে ওঠার মতো পরিসংখ্যানটি দিয়েছে সাউথ এশিয়ান লইয়ার্স ফোরাম। তাদের দেয়া তথ্য মতে ২০১২ সালে বাংলাদেশে ৭৭১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১০৬ নারীকে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫৭ জন। এ চিত্রটি কেবলই বিভিন্ন কোর্টে মামলা অথবা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান এর কয়েকগুণ বেশি হতে পারে।
বিদেশে নারীর প্রতি যে সহিংসতা হচ্ছে, তা বন্ধে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে একাত্ম হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ওইসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশের যথেষ্ট প্রতিবাদ হয় না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতাও নারী। একাধিক নারী মন্ত্রী রয়েছেন। অথচ খবরের কাগজে চোখ পড়তেই দেখা যায় কোনো না কোনো স্থানে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র।
গত বছরের জুলাই মাসে ধর্ষণের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন। তাদের দেয়া তথ্য মতে ওই মাসে ধর্ষণের পর ১৬ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের বলি হয়ে ৩৮ নারী। ৫ গৃহপরিচালিকা ও ইভটিজিং-এর কারণে ৩ নারীকে জীবন দিতে হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই মাসে ৭৭ জন ধর্ষণের শিকার হন। এদের মধ্যে নারী ২৬ ও শিশু ৫১ জন। ইভটিজিংয়ের শিকার হন ২৩ নারী।
সম্প্রতি ২৩ আগস্ট মুম্বাই থেকে বাংলাদেশে বাড়ি ফেরার পথে স্বামী ও ছয় বছর বয়সী ছেলের সামনেই ৩০ বছর বয়সী বাংলাদেশী নারী বিএসএফ সদস্যদের কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন। গত জুলাই মাসের ওই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি দোষী বিএসএফ সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংস্থা ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ (মাসুম) ।
সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, পর্নো ছবির অবাধ বিক্রি সর্বোপরি নারীর প্রতি সহিংসতায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। তাদের থামানোর যেন কেউ নেই। শিশু, কিশোরী, যুবতী, বৃদ্ধা, স্কুল ছাত্রী, পোষাক কর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমন কি ভিখারীনিও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণের কবল থেকে। মেয়ের জামাই কর্তৃক জোড়পূর্বক শাশুরী ধর্ষণের খবরও আমাদের শুনতে হয়। আবার প্রবাসী শশুরের অনুপুস্থিতিতে শাশুড়ীর সঙ্গে যৌন সর্ম্পকে জড়িয়ে জামাইয়ে সহযোগিতায় মেয়েকে গলাটিপে হত্যার ঘটনাও পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
এটি কোনো প্রতিবেশী দেশের তথ্য নয়, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের একটি চিত্র। এখন প্রশ্ন আসতে পারে ধর্ষণ কেন হয়? যারা ধর্ষণ করে তারা কারা? কী তাদের পরিচয়। যারা ধর্ষিতা হচ্ছেন তারা কারা? ধর্ষণের প্রকৃত কারণ কী?
এসব প্রশ্নে জবাব দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। কারণ, ধর্ষণের সঙ্গে যখন ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকে তখন এসব প্রশ্নে জবাব দেয়া সম্ভব হয় না।
আমরা সংবাদ মাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে দেখি কিছু সংবাদ মাধ্যম নারী ধর্ষণের শিকার হলে তা বড় হেডলাইনে প্রকাশ করে থাকে। ধর্ষিতার ছবি মাঝে মধ্যে প্রকাশ পায়। কিন্তু ধর্ষণের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে কেউ মাতামাতি করে না। প্রকৃত দোষী ব্যক্তির শাস্তির দাবিও জোড়ালো হয় না।
নারী ধর্ষণের জন্য আমি দুটি গুরুত্ব¡পূর্ণ কারণ উল্লেখ করতে চাই। এক. সমাজের মানুষ নিজ নিজ ধর্মের অনুসরণ না করা। দুই. নারী নিজেকে চোক্ষু শোভা করে ঘর থেকে বের হওয়া।
আমরা যদি একটু বিস্তারিতভাবে বলি তাহলে বলবো পৃথিবীর সব ধর্মই নারীকে সম্মান করতে শিখায়। কোনো ধর্ম গ্রন্থই নারী দেহ সব মানুষের কাছে দৃষ্টিনন্দন করে উপস্থাপন করতে বলেনি। সব ধর্মেই নারীকে সংযত পোশাক পড়তে বলা হয়েছে। আমরা যদি খবর নিয়ে দেখি যে, এ পর্যন্ত দেশে যত নারী ধর্ষিতা হয়েছে তারা স্ব স্ব ধর্ম পালনকারিনী ছিলেন কী-না? যারা ধর্ষিতা হয়েছে তাদের কত ভাগ ধর্ম পালন করেন?
যারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এমন পোশাক পড়েন যে ওই দিকে কোনো বখাটে যুবকের দৃষ্টি পাড়লে ওই যুবক উত্তেজিত হয়। কোনো যুবতীকে দেখলেও তাকে ভোগ করার কামনা করাটা যেমন বখাটেপনা আবার কোনো নারী অসংযত পোশাক পড়ে রাস্তায় বের হওয়াটাও নির্লজ্জতা। এ ধরণের পোশাকও বখাটেদের উত্তেজিত করতে সাহায্য করে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে বেশি জোড় দেয়া হয়নি। ধর্ম শিক্ষা নেই বললেই চলে। এক সময় স্কুল ও কলেজে সপ্তাহে এক দিন ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হতো। আর এখন ধর্ম চর্চা করা হলে তাকে উগ্রপন্থী অথবা মৌলবাদী বলে সন্দেহ করা হয়। এখন পবিত্র কোরআন, গীতা, বেদ ও বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলো অধ্যয়ণ করেন না এসব গ্রন্থের কথিত অনুসারীরা। ফলে সমাজে নানাবিদ অঘটন ঘটে।
অনেকে আইনের শাসনের কথা বলে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে নারী আর ধর্ষণের শিকার হবে না। অধিকার ফিরে পাবে প্রত্যেক নারী। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে দরকার নৈতিকতা।
যে সমাজে নারীকে কোনো সম্মান করা ছিল না। নির্যাতন করা হতো নারীকে। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে জীবন্ত কবর দেয়া হতো সেই সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠানো হয়েছিল মুহাম্মদ মোমÍফা স. কে। যিনি নারীকে দাসত্বের জীবন থেকে রাণীর আসনে বসিয়ে ছিলেন। এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যে সমাজে একজন নারী গভীর রাতে মরুভূমিতে একাকী পথ চলেছে তাদের মনের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় ছিল না। নৈতিক মানসম্পন্ন একদল দক্ষ নেতৃত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায় না থাকলে একটি সুন্দর সমাজ দেখার ইচ্ছা স্বপ্নেই থেকে যাবে।
লেখক : সৈয়দা নাসরিন ইসলাম