জালাল আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি : জঙ্গলে বিছা, সাপ কামড় দেয়, পেটে ঘা হয়, ব্যথা, যন্ত্রণায় ডাক্তার প্যারাসিটামল দেয়। কাজের সময় জুতা, কাপড়, ছাতা নেই, সারা শরীর বৃষ্টিতে ভিজে। বছরে একটা গামছা দেয়, পাতি রাখার জায়গা নাই, অতিরিক্ত পাতির পয়সা দেয়া হয় না। ২৩ কেজি পাতি তুললে ৪৮ টাকা নিরিখ। কম তুললে টাকা কমে কিন্তু এর বেশি তুললে অতিরিক্ত কাজের মজুরি দেয়া হয় না। ভাঙ্গা কল, ওজনে ভাল মতো হয়না। কিছু বললে চার্জশিট, বলে কোম্পানী লোকসান। মাস শেষ হওয়ার পূর্বে বাবুদের ৪-৫ কেজি পাতা দেয়া হয়, আর আমরা একমুটো পাতা পাই না। করুণ আর্তনাদে কথাগুলো বললেন মৌলভীবাজারের ভূরভুরি চা বাগানের মহিলা চা শ্রমিক ধনতি রবিদাস। এ কথাগুলো শুধু ধনতি রবিদাসের নয়, কথাগুলো দেশের ১৬৩ টি ও মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ৯১ টি চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের। সরেজমিনে জেলার চা বাগানগুলো ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
কীটনাশক ছিটানোর সময় হাতে পায়ে কিছু থাকে না। মুখোশ, গ্লাভস, চশমা কিছুই দেয়া হয় না। বিষাক্ত ঔষধ ব্যবহার করে অনেক সময় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। সকাল ৮টায় ১ লিটার ঔষধ ২০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করি। গায়ে পোশাক থাকে না। খালি গায়ে অধিকাংশ সময় প্রখর রোদে কীটনাশক ছিটানো হয়। সাবানের ব্যবস্থা থাকে না। বালি দিয়ে হাত ধুয়ে নাস্তা করতে হয়। বললেন কীটনাশক ছিটানো শ্রমিক মুকুল রায়।
১৯৬৫ সালে নির্মিত পাকা ঘর জরাজীর্ণ। সংস্কারের দাবি করলে বিভিন্ন অজুহাত। হাসপাতালে ট্রাক্টর দিয়ে ডেলিভারি রোগি নেয়া হয়। এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে চা বাগানের শ্রমিকদের জীবন চলছে। বললেন চাতলাপুর চা বাগানের শ্রমিক সাধন বাউরি।
ডানকান ব্রাদার্স আলীনগর চা বাগানের শ্রমিক সুমি রউতিয়া, মইনি রবিদাস, লক্ষী নায়েক, লছমন রবিদাসসহ শতাধিক চা শ্রমিক জানান, বাগানে বেকার শ্রমিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশাল এ বাগানে কোন ডাক্তার নেই। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার একজন ডাক্তার ১ ঘণ্টা থেকে চলে যান। একজন কম্পাউন্ডার থাকলেও তাকে সব সময় পাওয়া যায় না।
শমশেরনগর চা বাগানের দেওছড়া ডিভিশনের শ্রমিকরা চা বাগানের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানান, যে কোনো রোগ-বালাই হলেই সব রোগের ঔষধ দেয়া হয় প্যারাসিটামল। আলীনগর চা বাগানে ১ হাজার ৪৪০ জন শ্রমিক কর্মরত আর বেকার আছেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন।
চা শ্রমিক তথা শিল্পের কারিগররা অভিযোগ করে জানান, চা বাগান দেখতে মানুষ আসে কিন্তু চা বাগানকে টিকিয়ে রাখা চা শ্রমিকদের দু:খ, দুর্দশা কেউ দেখতে আসে না। শ্রমিকদের ঝুপড়ি ঘর, চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনিয়ম, শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে আলাদা জগতের মধ্যে পুরুষ শ্রমিকদেরকে মাদকাসক্ত করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও মহিলা চা শ্রমিকরা অভিযোগ করেন।
শমশেরনগরের ফাঁড়ি দেওছড়া চা বাগানের শ্রমিক শিউ প্রসাদ, শংকর রবিদাস, ঠাকুর রবিদাস, দেওরাজ রবিদাসসহ অনেকেই জানান, দেওছড়াসহ এ জেলার চা বাগানগুলোতে শ্রমিকরা সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত। ভাঙ্গা ও জরাজীর্ণ ঘর, বসবাস অনুপযোগী ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বৃষ্টিতে ভিজে একসাথে গাদাগাদি করে বসবাস করতে হয়।
চা শ্রমিকরা জানান, বিগত বছরসমূহে দেওছড়া চা বাগান শ্রমিকদের ঘর মেরামত, চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুব্যবস্থার জন্য বাগান ব্যবস্থাপক ও শ্রম উপ-পরিচালক শ্রীমঙ্গল বরাবরে দ’ুদফা আবেদন করার প্রায় দু’বছর অতিবাহিত হলেও কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কর্ণপাত করছে না। ঘরের দরজা-জানালা ভাঙ্গা, ফাটা, ছিটকারি নেই, কড়া নেই। দেয়াল ভাঙ্গা, চালের ছানি নষ্ট, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। বৃষ্টির পানিতে তাদের কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য মালামাল ভিজে নষ্ট হচ্ছে। চা বাগান ব্যবস্থাপকের কাছে আবেদন করে দু’বছরেও বাসগৃহ মেরামত ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুব্যবস্থাটুকু নিশ্চিত হয়নি।
শ্রমিকদের বসতঘরের খুবই শোচনীয় অবস্থা। দেওছড়া চা বাগানে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের ছোট ছোট মেয়েরা পার্শ্ববর্তী নার্সারিগুলোতে কঠিন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, ১৯৬৫ সালের শ্রম আইনে প্রতি একরে ১ জন শ্রমিক থাকার কথা। এ হিসেবে দেওছড়া চা বাগানে ৫৮০ একরে ৫৮০ জন শ্রমিক থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে আছে ২৬৭ জন। বাকি কাজ করানো হয় অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে। আবার অস্থায়ী শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি নামেমাত্র। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান কারিগর চা শিল্পের শ্রমিকরা এ ক্লাস বাগানে সর্বোচ্চ ৪৮ টাকা মজুরি পেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন। এ অবস্থায় বর্তমান বাজারদরের সাথে সঙ্গতি রেখে দৈনিক মজুরিতে শ্রমিকরা ১ কেজি চালের সাথে ১০০ গ্রাম ডাল ছাড়া আর কিছুই কিনতে পারছেন না বলে অভিযোগ করছেন। তার উপর নিরিখে ও ওজনে ঠকানো হচ্ছে তাদের। দেশে শ্রম আইন, মানবাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার থাকলেও চা বাগান শ্রমিকদের জন্য এগুলি বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেও শ্রমিকদের অভিযোগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডানকান ব্রাদার্সের শমশেরনগর ও আলীনগর চা বাগান ম্যানেজমেন্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বিগত নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে মজুরি ৩৮ টাকা থেকে ৪৮ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ৬ অক্টোবর কমিটির নির্বাচন। নির্বাচনের পর এসব নিয়ে শ্রমমন্ত্রীর সাথে আলাপ করা হবে।